Bangladesh

অর্থনৈতিক অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন করার অনুমতি দিল সরকার

তবে এই সিদ্ধান্তের আওতামুক্ত থাকবে- ইপিজেড বা দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলো

শ্রম অধিকার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষপর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন চালুর অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগকারী দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের আপত্তি সত্ত্বেও – যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র চাপ – সরকারের এ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।

এছাড়া, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) আইন সংশোধন করে শ্রম আইন ২০০৬’ এর শ্রমিক অধিকার সংক্রান্ত বিদ্যমান ধারাগুলো অন্তর্ভূক্ত করা হবে বলেও জানান তারা।

তবে এই সিদ্ধান্তের আওতামুক্ত থাকবে- ইপিজেড বা দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলো।

সূত্রগুলোর মতে, আগামী নভেম্বরে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে সরকার। তবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকে এটি কার্যকর হবে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-র মতে, এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা– কার্যকরভাবে নিশ্চিত করাসহ তাদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও আইন মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কারখানাসমূহে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর একটি উদ্যোগ নিয়েছে।

এর আওতায় আছে – বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০ এর ৩৪ নম্বর ধারা সংশোধন করে শ্রমিক অধিকার সংক্রান্ত শ্রম আইনের বিদ্যমান ধারা অন্তর্ভূক্ত করার উদ্যোগ। সংসদে এটি বিল হিসেবে পাঠানো হয়েছে।’

শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, “বেজা আইনে শ্রম অধিকার বিষয়ে ইপিজেড আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংযোজন করা হয়েছিল। এখন ওই ধারার বদলে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারাগুলো প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। ফলে ইকোনমিক জোনগুলোতে শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ শ্রম আইনের অন্যান্য অধিকার পাবে।”

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশের আইন মেনেই বেজায় দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ করতে হবে। আইন সংশোধনের বিলটি পার্লামেন্টে পাঠানো হয়েছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি তা পর্যালোচনা করছে। তারা সবকিছু ঠিকঠাক আছে মনে করলে সংসদ অধিবেশনে বিলটি উত্থাপন করবে।’
 
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) আইন এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) আইনের বিদ্যমান ধারায়, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা কিংবা ধর্মঘট আহ্বানের কোন সুযোগ নেই। বরং সেখানে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে কল্যাণ সমিতি করার বিধান রয়েছে।

শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন ও ধর্মঘট করার সুযোগ দিলে- ইপিজেড ও ইজেডভূক্ত কারখানাগুলোতে শ্রমিক অস্থিরতা হতে পারে বলে দীর্ঘদিন ধরে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন এসব অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা।

ইজেডভূক্ত কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করার সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএসকে বলেন, “আইএলও এবং বায়ারদের চাপে সরকার ইজেডগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ইজেডগুলোতে শ্রম আইন পুরোপুরি কার্যকর করা হবে না। শুধুমাত্র শ্রমিক অধিকার সংক্রান্ত শ্রম আইনের ধারাগুলো সংযোজন করা হবে।”

অবশ্য শ্রম অধিকার সংস্থাগুলোসহ শ্রমিক নেতা ও অধিকার কর্মীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।  

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ওয়ার্কাস ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার (জিডব্লিউটিইউসি)-র মহাসচিব জয় তালুকদার টিবিএসকে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে শ্রম আইন কার্যকর করা হবে খুবই প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ।  

দীর্ঘ আলোচনার সূত্র ধরে এ সিদ্ধান্ত
 
রানা প্লাজা ধ্বসের পর থেকেই ইপিজেডের কারখানাতে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করতে যুক্তরাষ্ট্র, আইএলও এবং ইইউ দাবি করলেও – বাংলাদেশ তাতে সম্মতি দেয়নি। বাংলাদেশের এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) সুবিধা অব্যাহত রাখতে যে ৯ দফা অ্যাকশন প্ল্যান দিয়েছে, তার মধ্যেও এ শর্ত জুড়ে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

সে প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ইপিজেডগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন বিনিয়োগ করেছে, তখন থেকে তাদের সঙ্গে সরকারের অঙ্গীকার রয়েছে যে, সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক ধর্মঘট করার সুযোগ থাকবে না। তাই ইপিজেডে কোনমতোই ট্রেড ইউনিয়ন চালু করা যাবে না।

তবে ইজেডগুলোতে যেহেতু এখনও খুব বেশি বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি এবং ইজেডে উৎপাদিত পণ্য দেশের বাজারে বিক্রির পাশাপাশি রপ্তানি হবে, তাই ইজেডগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করতে রাজী হয় সরকার। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো মেনে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

”মূলত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্যই সরকার ইপিজেডগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে সম্মতি দেয়নি। ইপিজেড ছাড়া দেশের সকল ধরণের কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর করা হবে। ফলে বেজার ১০০ ইকোনমিক জোন, হাইটেক শিল্প পার্কসহ সব ধরণের শিল্প পার্কে ট্রেড ইউনিয়ন চালু হবে”- জানান বেজা’র সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।

অব্যাহত বৈদেশিক চাপের মুখে গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত আইএলও’র গভর্নিং বডির কাউন্সিলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইজেডগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর করার অঙ্গীকার করেন।

তারপর থেকে গত কয়েকমাস ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও আইন মন্ত্রণালয় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিয়ে এ বিষয়ে একাধিক সভা করে ইজেড আইন সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান,  গত সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম যুক্তরাষ্ট্র- বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) সংক্রান্ত পরিষদের বৈঠকে, ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়টিকে এজেন্ডা হিসেবে রাখে যুক্তরাষ্ট্র।

ওই সভায়, আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় আইএলও’র গভর্নিং বডির কাউন্সিলের আগেই শ্রম আইন সংশোধন করার বিষয়ে ‍দৃশ্যমান অগ্রগতি তুলে ধরতে বাংলাদেশকে পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button