ইসলামী দলগুলো কোন দিকে যাবে
ভোট ব্যাংকের সুবিধা নিতে চায় প্রধান দুই দল
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর অবস্থান কী হবে তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। বিশেষ করে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত যেকোনো নামেই নির্দলীয় সরকার হলে কিংবা যেকোনো পরিস্থিতিতেই সরকারি দলের অধীনে নির্বাচন হলে ইসলামী দলগুলো কোন দিকে ঝুঁকতে পারে তা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় পক্ষই ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান ও ভোট ব্যাংকের সুবিধা নিতে চায় অনেকে মনে করেন। তবে এই মুহূর্তে প্রধান ইসলামী দলগুলো ‘কৌশলী’ ভূমিকা পালন করছে। তারা একদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার অন্যদিকে কোনো জোটেও নেই। আন্দোলনের পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানাচ্ছে কয়েকটি দল। আবার জামায়াতসহ কয়েকটি দল ইতোমধ্যেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে তাদের দলীয় অবস্থান জানিয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনসহ দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুতেও বরাবরই সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে ইসলামী দলগুলো। প্রায় সব ইসলামী দলের সমর্থনে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফাভিত্তিক আন্দোলন দেশের ইসলামী শক্তির অবস্থান পরিস্কার হয়ে ওঠেছিল কয়েক বছর আগে। নানা কারণে হেফাজতের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লেও ইসলামী দলগুলো কখনো বসে ছিল না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে হলেও আন্দোলন সংগ্রামে ছিল। দীর্ঘ এক দশক পর প্রকাশ্যে সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার পর প্রধান ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী এখন প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয়। যদিও দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে অফিসগুলো এখনো বন্ধ রয়েছে। কারাগারে বন্দী রয়েছে দলটির কেন্দ্রীয় আমির, সেক্রেটারি জেনারেলসহ কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতা। এখন জামায়াতসহ সব ইসলামী দলই রাজপথে সক্রিয়।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘটনার পর চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও জাতীয় সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ছাড়া এর আগের প্রায় সব নির্বাচনেই ভোটের মাঠে ইসলামী দলগুলোর ভোটের মাঠের গুরুত্ব ফুটে ওঠেছিল। এমনকি সরকার গঠনেও ইসলামী দলের সমর্থন লেগেছিল। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ১০ ইসলামী দলের বাইরেও অনেকগুলো ইসলামী দল রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সমর্থিত হিসেবে পরিচিত তিনটি নিবন্ধিত ইসলামী দল রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি এবং আন্তর্জাতিক মহলের কিছু পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে দেশে একটি গণতন্ত্রের আবহ তৈরি হওয়ায়। আবারো ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সরকারি ও বিরোধী দল বিএনপি উভয়ই এই দলগুলোকে নিজেদের পাশে পাওয়ার চেষ্টা করছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারি দল হেফাজতসহ কয়েকটি ইসলামী দলের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। তবে ছোট দু-একটি দল কৌশলগত কারণে সরকারের সাথে কিছুটা যোগাযোগের কথা স্বীকার করলেও সরকারের সাথে নির্বাচনী আঁতাত বা যোগাযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। দীর্ঘ ১০ বছর পর জামায়াত সমাবেশের অনুমতি পাওয়াকে কোনো কোনো মহল সন্দেহের চোখে দেখলেও জামায়াতের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিস্কার করে বলা হয়েছে- জামায়াত কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না এবং কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি আডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, জামায়াত এ মুহূর্তে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য এখন অন্য রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জামায়াতও এককভাবে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াত মনে করে এ ব্যাপারে যদি একটি রাজনৈতিক ঐক্য হলে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যমূলক নির্বাচন সম্ভব। এই ঐক্যের জন্যও জামায়াত চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি মনে করেন, প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে এই আন্দোলনের নেতৃত্বের আসনে আসতে হবে। সব দলকে কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে এক প্লাটফরমে আসতে হবে। ঈদের পর এখন মধ্য জূলাইয়ের দিকে সব রাজনৈতিক দল এক দফার ভিত্তিতে আন্দোলনে নেমে পড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এক প্রশ্নেœর জবাবে জামায়াতের এই শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ছাড়া জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ ব্যাপারে আমাদের পরিস্কার আবস্থান। তিনি বলেন, আমরা বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করছি কেয়ারটেকারের দাবিতে। আশা করি, এসব সমাবেশের মাধ্যমে সারা দেশে আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হবে।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমেদ বলেন, আমরা নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কিভাবে নির্বাচনে যাব সিদ্ধান্ত নেব। সেটা এককভাবে নাকি কারো সাথে জোট করে আমাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম শুরার বৈঠকে তা ঠিক করা হবে। আমরা ইসলামী দলগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য সৃষ্টিরও চেষ্টা আমাদের রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল। আমরা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না- এমন নীতিগত সিদ্ধান্ত আমাদের রয়েছে। তিনি বলেন, পাশাপাশি আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চলছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সেই কাজ শেষ হবে। এই মুহূর্তে অন্যান্য দলের মতো আমরাও জাতীয় সরকারের অধীনে পৃথকভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছি। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলে পরিস্থিতির আলোকে নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, সরকারি দল এবং বিরোধী দল বিএনপি কোনো পক্ষেরই মতিগতি এখনো আমাদের আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে এই মুহূর্তে আমরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে স্বতন্ত্রভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছি। সেটা বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরও দাবি। যে নামেই হোক নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে নির্বাচন অর্থবহ হবে দেশের জন্য কল্যাণকর হবে বলে আামরা মনে করি। তখন সবাই নিরাপদে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। এই মুহূর্তে আমরাসহ ইসলামী দলগুলো দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির কোনো দিকেই নেই। তবে সব ইসলামী দলের মধ্যে নির্বাচনকালীন একটি ঐক্য গড়ে তুলে অভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করা যায় কি না তা নিয়ে আলোচনা চিন্তা ভাবনা আছে। আবার আমাদের মধ্যে আগে ছয়টি দলের সমমন্বয়ে যে সমমনা ইসলামী দল নামে একটি মোর্চা ছিল সেটিকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার কথা আসছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা সত্য আওয়ামী ও বিএনপি উভয়ই যেহেতু ইসলামী দলগুলোকে কাছে পেতে চায় কিংবা তাদের ভোটের সুবিধাটা নিতে চায়। সেক্ষেত্রে সরকারি দলের সাথে ইসলামী দলগুলোর জোট করে নির্বাচনে যাওয়াটা সঙ্গতকারণেই সম্ভব হবে না। ফলে ইসলামী দলগুলো আলাদাভাবে নির্বাচন করুক- এটাই সরকারি দল চাইবে। সেক্ষেত্রে তারা সুবিধা পাবে। অন্যদিকে বিএনপিও এবার কি করে বোঝা মুশকিল। তারাও ইসলামী দলগুলোকে কাছে রেখে কথিত ‘মৌলবাদ’ মুক্ত থাকার একটা বিষয় দেখাতে চায় হয়তো বা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিই আসলে বলে দেবে আমরা কি করব, কিভাবে নির্বাচন করব। এখনই এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। এখন আমরা নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের চলমান আন্দোলনের সাথেই আছি।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন বলেন, এই মুহূর্তে কৌশলগত কারণে আমরা কোনো দিকে যাচ্ছি না। আমাদের দলের মহাসচিব মাওলানা মুমিনুল হক কারাবন্দী। তার মুক্তির ব্যাপারে আমাদের সরকারের সাথেও কথা বলতে হচ্ছে। তবে আমরা এটা বুঝতে পারছি যে, এবারে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন এদেশের মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না, হবে না। এমন নির্বাচন যাতে সরকার করতে না পারে তার জন্য বিদেশী চাপও রয়েছে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা কৌশলী অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছি। পরিস্থিতির আলোকে আপামর জনগণের ঝোঁকের দিকে লক্ষ্য করে আমরা আমাদের অবস্থান ঠিক করব। এই মুহূর্তে সমমনা ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে একটি মোর্চা গঠন নিয়ে চেষ্টার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, পরিস্থিতির আলোকে এই মোর্চা তাদের করণীয় ঠিক করতে পারবে। তারা কিভাবে নির্বাচন করবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার যদি সবার দাবি উপেক্ষা করে আগের মতোই কোনো নির্বাচন করতে চাইলে আমাদের অবস্থান কী হবে কৌশলগত কারণেই আমরা নিতে পারছি না। আমরা পরিস্থিতির আলোকেই সিদ্ধান্ত নেব।
খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, আমরাও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা ৫০-৬০ আসনকে টার্গেট করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা মনে করছি, সুষ্ঠু নির্বাচন করা একমাত্র একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই সম্ভব। তখনই মানুষ ভোট দেয়ার পরিবেশ পেতে পারে। ফলে এই দাবি আমাদেরও। তিনি বলেন, খেলাফত আন্দোলন অতীতে কখনো কারো সাথে জোট করে নির্বাচন করেনি। এবার আলাদা নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েই কাজ চলছে। তবে সমমনা ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে নিয়ে জোট করার একটি উদ্যোগ রয়েছে। সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সকলের দাবি উপেক্ষ করে বর্তমান সরকার নিজেদের অধীনেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করার দিকে গেলে খেলাফত আন্দোলন অংশ নেবে কিনা সেটা পরিস্থিতির আলোকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এখন এ ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে। দল তখন পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নেবে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও হেফাজতের অনেকে ইসলামী রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত রয়েছেন। তারা যেকোনো দিকে তাদের অবস্থান নিতে পারে। হেফাজতের প্লাটফরম থেকে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের ১৩ দফার যে আন্দোলন সেটা ঈমানী দাবি।
আমাদের নেতাদের বেশ কয়েকজন এখনো জেলে। আমাদের ওপর মামলা রয়েছে। এগুলো থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চাই। তবে নির্বাচনী পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশ জাতি ও ইসলামের জন্য কল্যাণকর হয় এমন এমন নির্দেশনা হেফাজতের পক্ষ থেকে দেয়া যেতে পারে। সেটা হলে হেফাজের মজলিসে শূরা তথা সর্বোচ্চ ফোরাম তখন নিতে পারবে।