উপসাগরীয় রাষ্ট্র সমূহের আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রকে: ইসরায়েল যেন ইরানের তেলক্ষেত্রে হামলা থেকে বিরত থাকে
উপসাগরীয় তিনটি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, উপসাগরীয় দেশগুলো ইরানের তেল স্থাপনায় হামলা চালানো থেকে ইসরায়েলকে বিরত রাখতে ওয়াশিংটনের কাছে তদবির করছে। কারণ তারা উদ্বিগ্ন যে সংঘাত বাড়লে তাদের নিজস্ব তেল স্থাপনাগুলো তেহরানের প্রক্সিদের (মিত্র সংগঠন) তোপের মুখে পড়তে পারে।
ইরানে আক্রমণ চালাতে ইসরায়েলকে আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে না বলে জানিয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারসহ উপসাগরীয় দেশগুলো। হামলা এড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে তারা এই অবস্থান নিয়েছে ।
দেশগুলোর সরকারি মহলের ঘনিষ্ঠ তিনটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
গত সপ্তাহে ইরানকে তার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইসরায়েল।
অন্যদিকে তেহরান বলেছে, যে কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক জবাব দেওয়া হবে। এই ধরনের পাল্টাপাল্টি হুমকি এ অঞ্চলে একটি বড় যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়তে পারে।
তেহরান চাইছে উপসাগরীয় দেশগুলো যাতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সখ্যতা ব্যবহার করে ইসরায়েলকে ইরানের তেল স্থাপনাগুলোতে হামলা থেকে বিরত রাখে। তাই ইরান উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর কূটনৈতিক চাপ দিচ্ছে।
ইরানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও এক ইরানি কূটনীতিক রয়টার্সকে বলেছেন, চলতি সপ্তাহে বৈঠকে ইরান সৌদি আরবকে সতর্ক করে বলেছে, হামলা চালাতে ইসরায়েলকে কোনো সহায়তা করলে, উপসাগরীয় দেশটির তেল স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা তারা দিতে পারবে না।
সৌদি রয়্যাল কোর্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সৌদি বিশ্লেষক আলী শিহাবি বলেন, ‘ইরান বলেছে উপসাগরীয় দেশগুলো যদি ইসরায়েলের জন্য নিজেদের আকাশসীমা খুলে দেয়, তাহলে তা হবে যুদ্ধের শামিল।’
ওই কূটনীতিক বলেন, ‘তেহরান রিয়াদকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে এই অঞ্চলের কেউ সমর্থন দিলে, ইরাক বা ইয়েমেনের মতো দেশগুলোতে থাকা তার মিত্ররা এর জবাব দিতে পারে।’
উপসাগরীয় ও ইরানি সূত্রগুলো জানিয়েছে, বুধবার সৌদি ডি ফ্যাক্টো শাসক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচির মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সম্ভাব্য ইসরায়েলি হামলা।
দেশটির সরকারি মহলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, ইরানি মন্ত্রীর সফর এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সৌদি-মার্কিন যোগাযোগ এই সংকট মোকাবিলায় একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার অংশ। এর মাধ্যমে সংকট মোকাবিলায় একত্রে কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওয়াশিংটনের এক ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর কর্মকর্তারা ইসরায়েলের সম্ভাব্য প্রতিশোধ হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
উপসাগরীয় সরকারগুলো ওয়াশিংটনের কাছে জানতে চেয়েছে, ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তারা কিছু জানে কি না। তবে হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বুধবার এক ফোনালাপে ইসরায়েলের প্রতিশোধ হামলা নিয়ে আলোচনা করেন, উভয় পক্ষই বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও ওয়াশিংটনভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের থিংক-ট্যাংক জোনাথন পানিকফ বলেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলোর উদ্বেগ ইসরায়েলকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে রাজি করানোর চেষ্টায় মূল চাবিকাঠি হতে পারে।’
তেল নিয়ে ঝুঁকি?
ইসরায়েলের হামলায় ইরানের তেল সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণের জন্য পর্যাপ্ত অতিরিক্ত তেল সরবরাহের সক্ষমতা আছে পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক-এর।
তবে এই অতিরিক্ত তেল উৎপাদন সক্ষমতার বেশিরভাগই উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত। তাই যদি সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেলের খনিগুলোয় হামলা করা হয়, তবে বিশ্বে তেল সরবরাহ সংকটের মুখে পড়তে পারে।
২০১৯ সালে আরামকো তেলক্ষেত্রে হামলার পর থেকে সৌদি আরব তার তেল খনিতে ইরানের হামলার বিষয়ে সতর্ক ছিল। ওই হামলায় বৈশ্বিক তেল সরবরাহের ৫% এরও বেশি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
যদিও ইরান ওই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেহরানের সঙ্গে রিয়াদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও আস্থার জায়গায় প্রশ্ন রয়ে গেছে। কারণ এখনও বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে মার্কিন সামরিক স্থাপনা বা সেনা মোতায়েন রয়েছে।
উপসাগরীয় আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, তেল স্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের সম্ভাবনাও আমিরাত ও মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
২০২২ সালে ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুথিরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি এডিএনওসির মালিকানাধীন একটি তেল শোধনাগারের কাছে রিফুয়েলিং ট্রাকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে এবং হামলার দায় স্বীকার করে।
উপসাগরীয় সূত্রটি জানিয়েছে, বর্তমানে তাই উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরায়েলকে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। তারা ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রকে তাদের আকাশসীমা দিয়ে যেতে দেবে না এবং আশা করা হচ্ছে, এতে তাদের তেল স্থাপনায় আঘাত হানবে না ইরান।
তিনটি উপসাগরীয় সূত্র জোর দিয়ে বলেছে, ইসরায়েল জর্ডান বা ইরাকের মধ্য দিয়ে হামলা চালাতে পারে। সৌদি, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা কাতারের আকাশসীমা ব্যবহারের আর সম্ভাবনা নেই এবং কৌশলগতভাবেও তার প্রয়োজন নেই।
বিশ্লেষকরা আরও বলেছেন, ইসরায়েলের আরও বিকল্প রয়েছে। তার কাছে রয়েছে মধ্য-আকাশে পুনরায় জ্বালানি সরবরাহ করার সক্ষমতা, যা দিয়ে চাইলে সে তার জেটগুলোকে লোহিত সাগর হয়ে ভারত মহাসাগর ঘুরিয়ে তারপর হামলা চালাতে পারবে।
‘ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধের মাঝখানে রয়েছি’
ইসরায়েলের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, ইসরায়েল তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা নির্ধারণ করছে। গত বুধবার পর্যন্তও তারা ইরানের তেলক্ষেত্রগুলোতে হামলা চালাবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
কর্মকর্তাদের মতে, প্রতিরক্ষা সংস্থা ইসরায়েলি নেতাদের কাছে যে কয়টি বিকল্প উপস্থাপন করেছিল তার মধ্যে এটি ছিল একটি।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বুধবার বলেন, ‘আমাদের হামলা হবে প্রাণঘাতী, সুনির্দিষ্ট এবং সর্বোপরি বিস্ময়কর। তারা বুঝতে পারবে না কী ঘটেছে এবং কীভাবে এটি ঘটেছে। তারা শুধু এর ফলাফল দেখবে’।
তিনটি উপসাগরীয় সূত্র জানিয়েছে, অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী প্রতিবেশী; যেমন- সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান ও বাহরাইনের সঙ্গে মিলে পরিস্থিতি প্রশমনের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরবের।
উপসাগরীয় আরেকটি সূত্র বলেছে, ‘আমরা একটি ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধের মাঝামাঝি থাকব। বিশেষ করে ইসরায়েল যদি ইরানের তেল স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা করে, তাহলে গভীর উদ্বেগ রয়েছে।’
তিনটি উপসাগরীয় সূত্র বলেছে, ইরানের তেল অবকাঠামোতে ইসরায়েলি হামলা বিশ্বব্যাপী; বিশেষত ইরানের শীর্ষ তেল ক্রেতা চীন এবং আগামী ৫ নভেম্বর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়া কমলা হ্যারিসের ওপর প্রভাব ফেলবে।
প্রথম উপসাগরীয় সূত্রটি বলেছে, যদি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলারে পৌঁছায়, তাহলে তা মার্কিন অর্থনীতি এবং নির্বাচনে হ্যারিসের জেতার সম্ভাবনা উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সুতরাং তারা (আমেরিকানরা) তেল যুদ্ধকে বাড়তে দেবে না।’
উপসাগরীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও প্যাট্রিয়ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, সব তেল স্থাপনার নিরাপত্তা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই প্রাথমিক পদ্ধতি হিসেবে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইরানকে এই সংকেত দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে- উপসাগরীয় দেশগুলো তার জন্য কোনো হুমকি নয়।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ার ইস্ট স্টাডিজের অধ্যাপক বার্নার্ড হেইকেল বলেন, রিয়াদ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, কারণ ইরানের সঙ্গে তার দূরত্ব বেশি নয়। ইরানিরা সহজেই সৌদির তেল স্থাপনাগুলোয় আঘাত করতে পারবে।