Hot

চাই ক্যারিবীয় দ্বীপের পাসপোর্ট কিনছেন বাংলাদেশিরা, অর্থ পাচারের নতুন কৌশল

হঠাৎ করেই যেন ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকছেন বাংলাদেশিরা। কিনছেন সে দেশীয় পাসপোর্ট। এন্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, ত্রিনিদাদ, গ্রেনেডার পাসপোর্ট কিনেছেন এমন কিছু প্রভাবশালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন পেশার মানুষজন। তবে ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়া বাদ দিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্রের দিকে ঝোঁকার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে সরকারের শীর্ষ মহলে। কিসের জন্যই বা তারা সেসব দেশকে পছন্দের তালিকায় নিয়েছেন তা নিয়ে চলছে ঢের আলোচনা। অখ্যাত দেশগুলোর পাসপোর্ট প্রকল্পে দুই হাতে কোটি কোটি টাকা ঢেলে নাগরিকত্বসহ পাসপোর্ট নেওয়ার পিছনে অর্থ পাচার কিংবা কোনো অপরাধের আভাস আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তর। সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, হতে পারে অনেকে নিজেদের ভোগ বিলাসের জন্য সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়ে রেখেছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ‘মিউচুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্সি’ চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহ করছে দুদক। অখ্যাত দ্বীপদেশসহ বিদেশি পাসপোর্টের আড়ালে অর্থ পাচার করা হচ্ছে কি না সে বিষয়েও কাজ করছে সংস্থার একাধিক টিম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্যারিবীয় কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রের পাসপোর্টে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বহুদেশে ভিসামুক্ত চলাচলের সুবিধা রয়েছে। এ কারণে কোটি টাকা বিনিয়োগে এসব দেশের পাসপোর্ট নিচ্ছেন অনেকে। এর মধ্যে গড়ে এককালীন দেড় থেকে ২ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগে নাগরিকত্বসহ পাসপোর্ট দেয় অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, ডমিনিকা, গ্রেনাডা, মাল্টা, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট লুসিয়া ও ভানুয়াতুর মতো কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র। এমনকি কয়েকটি দেশ সরাসরি তাদের জাতীয় উন্নয়ন তহবিলে অর্থ জমা নেয়। আবার কয়েকটির আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগের ৩ থেকে ৫ মাসের মধ্যেই নাগরিকত্ব মেলে। এর বাইরে স্যোশাল মিডিয়া ফেসবুকে ‘সিটিজেন ইনভেস্ট’ নামে একটি পেজের মাধ্যমে ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্রের পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়ার নানা পোস্ট রয়েছে। একটি পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্যারিবিয়ান পাসপোর্ট থাকলে ১৪০টির বেশি দেশে ভিসা ফ্রি ট্রাভেল করার সুযোগ রয়েছে। এজন্য খরচ করতে হবে ২ লাখ ইউএস ডলার।

এর বাইরেও ফেসবুকে নামেবেনামে পেজ খুলে ক্যারিবীয় দ্বীপের বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট পাওয়ার লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি। অনেকে আবার খুলেছেন এজেন্ট অফিস। তবে গুলশান এবং বনানীর একাধিক এজেন্ট অফিসে সরেজমিনে গেলেও এসব বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ প্রতিনিধিরা। কারা নিচ্ছে এসব পাসপোর্ট, সে তথ্য দিতে চান না কেউই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনানীর এক অফিসের এজেন্ট জানান, অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, গ্রেনাডা, সেন্ট কিটসসহ কয়েকটি দেশের পাসপোর্ট প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ এখন আগে থেকে বাড়ানো হয়েছে। আগে ১ লাখ মার্কিন ডলার হলেও বর্তমানে তা বেড়ে দেড় লাখ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে আছে সার্ভিস চার্জ। সব মিলিয়ে চারজনের একটি পরিবারের জন্য বারবুডার পাসপোর্টে খরচ ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। প্রদত্ত টাকার পুরোটাই সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যাংক হিসাবে জমা করা হবে। টাকা যাবে বিশেষ এজেন্টের মাধ্যমে।

আপনাদের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত কতজন বিনিয়োগ করেছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, এটা শতভাগ গোপনীয়। কোনো ক্লায়েন্টের তথ্য তারা প্রকাশ করেন না। এক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা তাদের ব্যবসায়িক নীতি। এমনকি ক্লায়েন্টের মোবাইল ফোন নম্বর পর্যন্ত গোপন রাখা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বীকার করেন, বর্তমানে ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর নাগরিকত্ব প্রকল্পে বিনিয়োগের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। এমনকি ক্যারিবীয় পাসপোর্টে আর ‘নো ভিসা’ও দিচ্ছে না পাসপোর্ট অধিদপ্তর। তবে দেশের বাইরে যেতে পারলে এসব পাসপোর্ট দিয়ে অনায়াসে ইউরোপ-আমেরিকায় ভিসামুক্ত চলাচল করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল ইফতেখার আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ বিষয়টি এখনো আমাদের নজরে আসেনি। তবে বিষয়টি উদ্বেগেরও বটে। আমাদের বিশ্বাস, যথাযথ কর্তৃপক্ষ অবশ্যই তা খতিয়ে দেখবেন। র‌্যাবও ছায়া তদন্তের মতো করে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দ্বীপরাষ্ট্রগুলোয় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএস-এর তৎপরতা ও অর্থ পাচার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে পাঁচ বছর আগেই প্রতিবেদন দেয় পুলিশের বিশেষ শাখা-এসবি। এর সূত্র ধরে ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর এক বিশেষ সভা ডাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, পুলিশ ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি বলেন, যেসব বাংলাদেশি ডমিনিকান রিপাবলিক, অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা ও সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস দ্বীপদেশগুলোর নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ছাড়া অর্থ পাচারের বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য ক্যারিবীয় পাসপোর্টে ‘নো ভিসা’ দেওয়ার আগে বিএফআইইউ-এর মতামত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পরে সভা থেকে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে রহস্যজনক কারণে পরে তালিকা প্রণয়নের কাজ আর বেশি দূর এগোয়নি।

এদিকে দুদকের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানকার ‘ব্যাংকিং চ্যানেল’ ব্যবহার করে অর্থ পাচার করছেন দেশের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এই তালিকায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তাও আছেন। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী নজরদারি থাকে না এসব দেশের বিনিয়োগ এবং ব্যাংক খাতে। সেই সুযোগে অনায়াসে কালো টাকা সাদা করা যায় ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে। অর্থ পাচার রোধ এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের একাধিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে দুদক। প্রতিনিধি দলগুলো বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে যৌথ সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন। তবে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সহযোগিতা চুক্তি এখনো সম্ভব হয়নি দুদকের পক্ষে। ফলে দৃশ্যমান কোনো তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানায় সূত্রগুলো।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা গোলাম হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর এবি০৫৩৩৫৬) ও তার পরিবারের সদস্যরা এন্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার পাসপোর্ট নিয়েছেন। তার ছেলে সাবমীর সাদাত হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর এবি ০৫৪৯৪৬), সাদমান সাদাত হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর এবি ০৫৩৩৫৭), স্ত্রী আফরোজা হোসেন। তাদের পাসপোর্টের কপি বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার পরিবারের সদস্য আমেরিকায় থাকে। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাকে এন্টিগুয়া বারবুডার পাসপোর্ট নিয়ে দিয়েছে। এটা তো দোষের কিছু না। একই দ্বীপরাষ্ট্রের পাসপোর্ট নিয়েছেন, গুলশানের বাসিন্দা এ কে এম ইফতেখার হোসেন (পাসপোর্ট নম্বর এবি ০৬৮৮২০)। তার পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে আছেন স্ত্রী সৈয়দা আসেফা আফরিন আলী (পাসপোর্ট নম্বর এবি০৬৮৮৩২), মেয়ে জারিয়া ফারহান হোসেন ও ছেলে জাইয়ান ওয়াসিফ হোসেন। সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস নামের অখ্যাত এক দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন ফেনীর বাসিন্দা আবদুল ফাত্তাহ। সম্প্রতি তিনি ওই দেশের পাসপোর্ট (আরই০১০৫৮৩৫) দেখিয়ে ‘নো ভিসা’র আবেদন করেন। পরে তার নাগরিকত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আবেদনের কপি পাঠানো হয় এনএসআই (জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা) কার্যালয়ে।

পাসপোর্টে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী আবদুল ফাত্তাহর বাবার নাম মৌলবি আবদুল হাদী। মায়ের নাম মঞ্জুরা খানম চৌধুরানী। গ্রামের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজী, নতুন মুনসুরহাটের জগতপুর। তিনি সেন্ট কিটসের পাসপোর্ট নেন ২০২১ সালের ১৮ মার্চ। দেশটিতে তার নাগরিক নিবন্ধন নম্বর সি ৫১২৬৫। আবদুল ফাত্তাহ ছাড়াও সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নাগরিকত্ব নিয়েছেন গুলশানের বাসিন্দা জিয়াউর রহমান। ২০১৮ সালের ২৬ জুন তিনি দেশটির পাসপোর্ট হাতে পান (নম্বর আরই০০৭০১৯০)। সম্প্রতি তিনি নিজেকে দ্বৈত নাগরিক দেখিয়ে ঢাকায় ‘নো ভিসা’র আবেদন করেন। বিদেশি পাসপোর্টে তার বর্তমান ঠিকানা গুলশান এলাকার ৮৮ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ি। তার বাবার নাম আহমাদুর রহমান এবং মা মারিয়াম রহমান। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পাথরঘাটা ৫৬ বান্ডেল রোড।

চট্টগ্রামের বৃহৎ শিল্পপরিবার টিকে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তফা হায়দার ও তার স্ত্রী ফাতেমা সালমা কামাল। গ্রেনাডিয়ান হিসেবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একই সময় পাসপোর্ট হাতে পান তারা। সেন্ট জর্জেস থেকে ২০২৩ সালের ৪ মে তাদের পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। ২০২৮ সালের ৪ মে পর্যন্ত এর মেয়াদ রয়েছে। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ‘নো ভিসা’ আবেদনে তারা গ্রানাডার দুটি পাসপোর্টের কপি সংযুক্ত করেন। এতে মোস্তফা হায়দারের পাসপোর্ট নম্বর জিএ০৮৫০৯১ এবং স্ত্রী ফাতেমা সালমা কামালের পাসপোর্ট নম্বর জিএ০৮৫০৯০। দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আবেদনের সঙ্গে নিজেদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও জমা দেন তারা। সূত্র বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মেজর শরিফ। পরিবার নিয়ে তিনি বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বসবাস করলেও পরিবারের সব সদস্যের এন্টিগুয়া বারবুডার পাসপোর্ট কিনেছেন লাখ লাখ ডলার খরচ করে। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থ পাচার কিংবা সন্ত্রাসী কোনো কর্মকাণ্ডের যোগসূত্রতা আছে কি না সে বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর এবং সিআইডি নজরদারি শুরু করেছে। বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor