Jannah Theme License is not validated, Go to the theme options page to validate the license, You need a single license for each domain name.
Trending

চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ১০০% বাড়তি শুল্ক বসানোর পেছনে কি বিরল খনিজ

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ যে নতুন মোড় নিল, তার কেন্দ্রবিন্দুতে এবার বিরল খনিজ ধাতু। একটি নয়— মোট ১৭ টি ধাতু নিয়ে এই বিরল খনিজ ধাতুর পরিবার।

গত বৃহস্পতিবার চীন বিরল ধাতুর রপ্তানিতে নতুন করে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্টা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। নতুন করে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের করবেন বলে হুংকার দিয়েছেন তিনি।

এমনকি ট্রাম্প জানিয়েছেন, চলতি মাসে এশিয়া সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকও তিনি বাতিল করতে পারেন। এ টানাপোড়েন নতুন নয়। বহু বছর ধরে চীন বিশ্বের বিরল ধাতুর বাজারে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছে। নিজেদের শিল্পনীতির অংশ হিসেবেই তারা এটা করেছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের ‘পাল্টা শুল্ক’নীতির জবাব হিসেবেই বেইজিংয়ের এ সিদ্ধান্তকে দেখা হচ্ছে। এর আগে জেনেভায় দুই দেশের আলোচনায় ‘বাণিজ্যবিরতি’ ঘোষণার পর ওয়াশিংটন আশা করেছিল, চীন হয়তো রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবে। কিন্তু তারা সেটা না করে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

বিরল ধাতু কী

বিরল ধাতু বলতে পর্যায় সারণির ১৭টি ধাতব উপাদানকে বোঝায়। এর মধ্যে আছে স্ক্যান্ডিয়াম, ইট্রিয়াম ও ল্যানথানাইড সিরিজের উপাদান। ‘বিরল’ নামটি বিভ্রান্তিকর। কেননা ভূগর্ভে এসব উপাদানের উপস্থিতি যে কম তা নয়; বরং এগুলো আহরণ ও পরিশোধন করা জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। সেই সঙ্গে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
এই ধাতুগুলো ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি কল্পনাই করা যায় না। স্মার্টফোন, উইন্ড টারবাইন, এলইডি বাতি, টেলিভিশনের পর্দা—সব ক্ষেত্রেই এগুলোর ব্যবহার অপরিহার্য।

ইলেকট্রিক বা বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, এমআরআই মেশিন, এমনকি ক্যানসার চিকিৎসাতেও এসব ধাতু ব্যবহৃত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শিল্পেও এগুলোর ভূমিকা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিএসআইএসের ২০২৫ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন, লেজার ও স্যাটেলাইট—সবখানেই বিরল ধাতুর ব্যবহার রয়েছে।

চীনের নিয়ন্ত্রণ

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট উত্তোলিত বিরল ধাতুর ৬১ শতাংশ আসে চীন থেকে। পরিশোধন বা প্রক্রিয়াজাতকরণের পর্যায়ে চীনের হিস্যা ৯২ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র ঠিক এখানেই ধরা বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলেন, ট্রাম্প যে চীনের সঙ্গে প্রতিবারই হম্বিতম্বি করার পর পিছিয়ে আসেন, এর পেছনে আছে এ বিরল ধাতু। কেননা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানি করা বিরল ধাতুর ৭০ শতাংশই এসেছে চীন থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি খনি থাকলেও সেখানে আহরিত ধাতু এখনো আলাদা করার জন্য চীনেই পাঠানো হয়।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ক্রিটিক্যাল মিনারেল সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক গ্রেসলিন বাসকারান বলেন, চীন এখন এ নির্ভরশীলতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কৌশলগত চাপে পরিণত করছে।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যানুসারে, চীন তুলনামূলকভাবে দাম কম রেখে নতুন প্রতিযোগীদের বাজারে আসতে নিরুৎসাহিত করে। ফলে পশ্চিমাদের পক্ষে বিকল্প সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষক গ্রেসলিন বাসকারান বলেন, চীন উৎপাদন কমিয়ে দাম বাড়ায় না; বরং বাজারের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে প্রয়োজনমতো সম্পদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।

চীনের এ নিয়ন্ত্রণ এক দিনে অর্জিত হয়নি। ১৯৯০–এর দশকে শিথিল পরিবেশ আইন আর অগণিত ছোট খনির কল্যাণে সে দেশে এই বিরল খনিজের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সময়ে কৌশলগতভাবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের জিএমের ম্যাগনেট বিভাগ ও ফরাসি কোম্পানি ইউজিম্যাগ অধিগ্রহণ করে উৎপাদনব্যবস্থা চীনে সরিয়ে আনে। ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রে শেষ দুটি চুম্বক কারখানাও ২০১০ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।

জাপান তখন চীনের অনানুষ্ঠানিক রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় বিরল খনিজ মজুত করতে শুরু করে। অন্যদিকে চীন পর্যায়ক্রমে এই খাত রাষ্ট্রায়ত্ত করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এখন চীনের দুটি বৃহৎ কোম্পানি—চায়না নর্দার্ন রেয়ার আর্থ ও চায়না রেয়ার আর্থ গ্রুপ পুরো শিল্প নিয়ন্ত্রণ করছে।

তবে পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। জি-৭ সম্প্রতি মান নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। লক্ষ্য হচ্ছে, ভবিষ্যতে চীনের অতি সস্তা চুম্বক পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। যুক্তরাষ্ট্র আরও এগিয়ে গিয়ে এমপি ম্যাটেরিয়ালসকে দ্বিগুণ দামে ধাতু কিনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্রতিরক্ষা খাত ছাড়া অন্যান্য খাতে এই উচ্চ মূল্যের বিকল্প পণ্যের চাহিদা তেমন একটা থাকবে না।

ট্রাম্পের পাল্টা হুমকি

চীনের নতুন নিষেধাজ্ঞায় ট্রাম্পের প্রশাসন বিপাকে পড়েছে। নতুন তালিকায় চীন আরও পাঁচটি উপাদান যুক্ত করেছে—হলমিয়াম, আরবিয়াম, থুলিয়াম, ইউরোপিয়াম ও ইটারবিয়াম। এতে নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়েছে, এমন উপাদানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২। একই সঙ্গে বিরল ধাতুসংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও এখন থেকে অনুমতিপত্র লাগবে।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, চীন যে বৈরী ‘আদেশ’ দিয়েছে, তার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র আর্থিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে। তিনি আরও বলেন, ‘ওরা প্রতিটি উপাদানে একচেটিয়া দখল নিতে চায়, অথচ আমাদের কাছে সেই বিকল্প দুই জায়গায় রয়েছে।’

এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণকে বিশ্লেষকেরা বাণিজ্যযুদ্ধের নতুন ধাপ হিসেবে দেখছেন, যেখানে লড়াই কেবল শুল্ক আরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা প্রযুক্তি ও সম্পদনির্ভর কৌশলগত প্রতিযোগিতায় ছড়িয়ে পড়ছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ লড়াই কেবল বাজার নয়, জাতীয় নিরাপত্তা ও শিল্প স্বনির্ভরতার প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে। চীন তার ‘বিরল ধাতু শক্তি’ ব্যবহার করে বিশ্ববাণিজ্যে নতুন ভারসাম্য তৈরি করছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে, সেই নির্ভরশীলতার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে।

ভূরাজনীতি ও অর্থনীতির নতুন ক্ষেত্র

বিশ্বরাজনীতির নতুন লড়াই এখন সিলিকনের সূক্ষ্ম দানা আর মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা বিরল ধাতু নিয়ে। তেল ও তথ্যযুদ্ধের পর এখন পৃথিবীতে চলছে প্রযুক্তিযুদ্ধ। সেই প্রযুক্তির চালিকা শক্তি চিপ বা সেমিকন্ডাক্টর। চিপ বানানোর মূল উপাদান হলো সিলিকন। আর সেই সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ার পেছনে বিরল খনিজ ধাতুর প্রয়োজন অপরিসীম।

ইউক্রেন যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন চুক্তি করেছে, যেখানে ভবিষ্যতে রাজস্ব ভাগাভাগির নিশ্চয়তা রাখা হয়েছে। বলা যায়, এই চুক্তি করে তারা ট্রাম্পকে তুষ্ট করেছে। এ প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অপদস্থ হওয়ার কথা পাঠকদের মনে আছে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় বিরল ধাতুর সম্ভাবনা আছে, তা দিয়ে দেশটি চতুরতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে টোপ দিয়েছে এবং সেটা তারা গিলেছে। ফলে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন হলো, তার পেছনে এর ভূমিকা আছে।

অন্যদিকে ভারতে বিরল খনিজ মজুত থাকলেও তারা এখনো চীনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর চীনের সঙ্গে যে তাদের সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তার অন্যতম শর্তই ছিল চীন ভারতের কাছে বিরল খনিজ রপ্তানিতে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তা শিথিল করা। ফলে এই ধাতু এখন কেবল প্রযুক্তি বা শিল্পের উপাদান নয়; বরং তা হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক প্রভাব, জোট রাজনীতি ও আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্যের নতুন কেন্দ্রবিন্দু।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button