Hot

তরুণদের ৪১% কাজে নেই, শিক্ষায়ও নেই

  • জনশুমারি ধরে হিসাব করে দেখা যায়, নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ।
  • নিষ্ক্রিয় তরুণের হার সবচেয়ে কম বরিশালে, বেশি সিলেটে। 
  • তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। 

বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। মানে হলো তাঁরা পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই; এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। মেয়েদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার বেশি, ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ। ছেলেদের মধ্যে এ হার কম, ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এই ধরনের তরুণের সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২২ প্রতিবেদনে নিষ্ক্রিয় তরুণের এই হার তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি গত বুধবার প্রকাশ করা হয়। বিবিএস নিষ্ক্রিয় তরুণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ধরেছে ১৫ থেকে ২৪ বছর। তাদের হার ধরে হিসাব করে দেখা যায়, নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ।

অর্থনীতিবিদ ও শ্রমবাজারবিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়েদের বাল্যবিবাহ, কাজ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানে ঘাটতি, যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া, শোভন কাজের অভাব ও সামাজিক পরিস্থিতি নিষ্ক্রিয় তরুণের হার বেশি হওয়ার কারণ।

১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের বড় অংশ নিষ্ক্রিয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জনগোষ্ঠী সামাজিক ‘অস্থিরতার কারণ’ হতে পারে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘বৈশ্বিক কর্মসংস্থান নীতি পর্যালোচনা-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণত উন্নত বিশ্বে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার কম হয়। বেশি হয় উন্নয়নশীল ও স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশের মতো ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে হারটি উচ্চ। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০৫ সালে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার গণনা শুরু হয়। ২০২০ সালে বিশ্বে এ হার ছিল সর্বোচ্চ—২৫ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। এর কারণ ছিল করোনা মহামারি। ২০২২ সালে তা কমে সাড়ে ২৩ শতাংশে নেমেছে।

নিষ্ক্রিয় তরুণেরা নানা সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারেন। যেমন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশে এখন যে ‘কিশোর গ্যাং’ সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তার একটি কারণ নিষ্ক্রিয় তরুণ বেড়ে যাওয়া।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে (এসডিজি) নিষ্ক্রিয় তরুণের হার কমিয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশও কমানোর লক্ষ্য ঠিক করেছে। যদিও তা পূরণের অগ্রগতি নেই। বরং নিষ্ক্রিয় তরুণ বাড়ছে। এসভিআরএস-২০২১ অনুযায়ী, তখন নিষ্ক্রিয় তরুণের হার ছিল ৩৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এক বছরে তা প্রায় ১ শতাংশীয় বিন্দু বেড়েছে।

শ্রমশক্তি জরিপে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা। সেখানে সর্বশেষ সাত দিনে এক ঘণ্টার জন্য অর্থের বিনিময়ে কাজ করলেই ধরা হয় যে তিনি বেকার নন।

আলমগীর হোসেন, বিবিএসের এসভিআরএস ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এই ধরনের তরুণদের নাম দিয়েছে বিযুক্ত যুবসমাজ। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিযুক্ত যুবসমাজের মধ্যে চার ধরনের প্রবণতা দেখা যায়—১. মানসিক বিষণ্নতা। ২. মাদকাসক্তি। ৩. পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতায় জড়িত হওয়া এবং ৪. উগ্রবাদের দিকে ঝোঁক।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিযুক্ত যুবসমাজের হার বেড়ে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এটা সামাজিক অস্থিরতা তৈরির একটি কারণ হতে পারে।

নিষ্ক্রিয় তরুণের হার কমাতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জোর দেওয়া এবং ঝরে পড়াদের আবার শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা জরুরি। তিনি বলেন, নারীদের বিনা মূল্যের পারিবারিক শ্রমের বোঝাও কমাতে হবে। নইলে তাঁরা কীভাবে শ্রমবাজারে আসবেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন

কত তরুণ নিষ্ক্রিয়

বিবিএসের জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন-২০২২ বলছে, দেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ১৬ লাখ; যা মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশের কিছু বেশি। স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই জনসংখ্যার ৪০ দশমিক ৬৭ শতাংশ নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ, সংখ্যায় তাঁরা প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ।

নিষ্ক্রিয় তরুণের হিসাবটি বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপে উঠে আসে। ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার ২২ শতাংশ (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী)। তবে স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের সঙ্গে শ্রমশক্তি জরিপের ফলাফলের কিছু পার্থক্য রয়েছে। কারণ, সংজ্ঞাগত ভিন্নতা।

বিবিএসের এসভিআরএস ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, শ্রমশক্তি জরিপে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা। সেখানে সর্বশেষ সাত দিনে এক ঘণ্টার জন্য অর্থের বিনিময়ে কাজ করলেই ধরা হয় যে তিনি বেকার নন। এসভিআরএসে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে ব্যক্তি নিজেকে কী মনে করেন—বেকার না কর্মজীবী। ২০২১ সাল থেকে এসভিআরএসে নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীর হিসাব দেওয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি বুঝতেই এই হিসাব তৈরি শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, এই জরিপে নমুনা হিসাবে নেওয়া হয়েছে ৩ লাখের বেশি খানা (পরিবার)।

বিবিএসের হিসাবে, মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৯ বছর ৩ মাস। মানে হলো, তাঁদের যখন শ্রমবাজারে প্রবেশের কথা, তখন তাঁরা ঘর ও সন্তান সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। নারীর গৃহস্থালি কাজ কর্মসংস্থান হিসেবে গণ্য হয় না।

কেন নিষ্ক্রিয়

দেশে বড় অংশের তরুণ নিষ্ক্রিয় কেন, এ প্রশ্নে ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে উত্তর ভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়েদের একটি অংশ বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। আরেকাংশের বিয়ে হচ্ছে অল্প বয়সে। বিবিএসের হিসাবে, মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৯ বছর ৩ মাস। মানে হলো, তাঁদের যখন শ্রমবাজারে প্রবেশের কথা, তখন তাঁরা ঘর ও সন্তান সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। নারীর গৃহস্থালি কাজ কর্মসংস্থান হিসেবে গণ্য হয় না।

ঢাকার মিরপুরের এক তরুণী ১৭ বছর বয়সে বাল্যবিবাহের শিকার হন। তিনি এখন এক সন্তানের জননী। পড়াশোনাও বাদ দিয়েছেন। যেহেতু তিনি এখন পড়াশোনা, চাকরি অথবা প্রশিক্ষণে নেই, সেহেতু তিনি পড়েছেন নিষ্ক্রিয় তরুণদের তালিকায়।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই তরুণী বলেন, পড়াশোনা চলছিল। তখন পরিবার থেকে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়। পড়াশোনা শেষে তাঁর আর চাকরি করা হলো না।

বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। জাতীয়ভাবে বেকারত্বের হার যেখানে সাড়ে ৩ শতাংশের মতো, সেখানে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮ শতাংশ।

ছেলেদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার একটি বড় কারণ তাঁদের পছন্দমতো কাজ খুঁজে না পাওয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে তরুণেরা যে কাজ খুঁজছেন, সেটা তাঁরা পান না। আবার যে কাজ আছে, যেটা করার মতো দক্ষতার ঘাটতিও প্রকট।

বরিশালের একটি কলেজ থেকে স্নাতক (পাস) ডিগ্রি অর্জন করে বছর দেড়েক ধরে কাজ খুঁজছেন এক তরুণ। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পড়াশোনা করে এখন না পারি কারখানায় শ্রমিকের চাকরি করতে, না পারি দোকানে কাজ করতে। ছোটখাটো হলেও একটি সরকারি চাকরির চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে তিনি বুঝেছেন এত বছরের শিক্ষাজীবনে ভালোভাবে না শিখেছেন বাংলা, না ইংরেজি, না গণিত। অথচ তাঁর পাশের বাড়ির তরুণ মোটরসাইকেল মেরামতের কাজ শিখে এখন নিজেই দোকান দিয়েছেন।

বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। জাতীয়ভাবে বেকারত্বের হার যেখানে সাড়ে ৩ শতাংশের মতো, সেখানে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৮ শতাংশ। শিক্ষার হার যত বেশি, বেকারত্বের হার তত বেশি। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব প্রায় ১২ শতাংশ। দেশের মোট বেকারের প্রতি চারজনের একজন উচ্চশিক্ষিত।

‘কারিগরি শিক্ষায় জোর দেওয়া জরুরি’

নিষ্ক্রিয় তরুণের হার সবচেয়ে কম বরিশালে, বেশি সিলেটে। বরিশালে ৩৮ দশমিক ৩২, রংপুরে ৩৯ দশমিক ৪, রাজশাহীতে ৩৯ দশমিক শূন্য ৯, ঢাকায় ৩৯ দশমিক ৫৩, খুলনায় ৩৯ দশমিক ৬৬, ময়মনসিংহে ৪০ দশমিক ৫০, চট্টগ্রামে ৪৩ দশমিক ৭৭ এবং সিলেটে ৪৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়।

নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা না কমার জন্য অর্থনীতিবিদ ও শ্রমবাজারবিশেষজ্ঞরা কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন। প্রথমত, নারীদের বিপুলভাবে শ্রমবাজারে আনা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, বাজারে যে ধরনের দক্ষতার চাহিদা রয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। কারিগরি শিক্ষা যথেষ্ট জোর পাচ্ছে না। তৃতীয়ত, শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে অনেক তরুণের বাংলা ও ইংরেজি ভাষাজ্ঞান দুর্বল। চতুর্থত, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মিলিয়ে নতুন কর্মসংস্থান ততটা তৈরি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন মনে করেন, নিষ্ক্রিয় তরুণের হার কমাতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জোর দেওয়া এবং ঝরে পড়াদের আবার শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা জরুরি। তিনি বলেন, নারীদের বিনা মূল্যের পারিবারিক শ্রমের বোঝাও কমাতে হবে। নইলে তাঁরা কীভাবে শ্রমবাজারে আসবেন।

বিনায়ক সেন আরও বলেন, বাংলাদেশে প্রজনন হার একটি জায়গায় আটকে আছে। কারণ হলো জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার লক্ষ্য অনুযায়ী বাড়েনি। এ ক্ষেত্রে উন্নতি না করতে পারলে নারীদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার কমবে না।

Show More

7 Comments

  1. Simply wish to say your article is as surprising.
    The clearness in your post is just great and i could assume you’re an expert on this subject.
    Well with your permission allow me to grab your RSS feed to keep up to date with forthcoming post.
    Thanks a million and please keep up the rewarding work.

    Also visit my web page: what does vpn stand for

  2. Fantastic items from you, man. I have take into accout
    your stuff prior to and you’re simply extremely magnificent.
    I really like what you have received right here, certainly like what you are saying and
    the way in which by which you assert it. You are making it entertaining and you continue to
    care for to keep it wise. I can’t wait to learn much more from you.
    That is really a wonderful website.

    My blog post eharmony special coupon code 2024

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button