Bangladesh

‘দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ওটিপি’ নিয়ে বাংলাদেশের প্রি-পেইড বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ভোগান্তির একশেষ

উপায়ান্তর না দেখে পুরো ওটিপি কোড প্রিন্ট করান সালাহউদ্দিন, এরপর একজনকে পাশে দাঁড়িয়ে সংখ্যাগুলো পড়তে বলেন। এভাবেই এক মিনিটের কাজটা করতে হয়েছে ঘণ্টাখানেক ধরে।  

৩২০টি সংখ্যার ওটিপি কোড ম্যাসেজ পেয়েছেন বিদ্যুৎসেবার প্রি-পেইড গ্রাহক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।

৩২০টি সংখ্যা! বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটারের ব্যালান্স রিচার্জের জন্য রাজধানীর শনির আখড়ার বাসিন্দা সালাহউদ্দিন মাহমুদের ফোনে ঠিক এতগুলো সংখ্যারই ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপি কোড পাঠানো হয়েছে।

সালাহউদ্দিনের মিটারের ব্যালান্স তখন শেষ হওয়ার পথে, শঙ্কায় ছিলেন যেকোনো মুহূর্তেই বিদ্যুৎহীন হবে তাঁর বাড়ি। 

তাই প্রিপেইড মিটারে ব্যালার স্থানান্তর করার পর তিনি ওটিপি কোডের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। মিটারের বোতাম চেপে ওটিপি প্রবেশ করালেই আর দুশ্চিন্তাও থাকতো না। 

সচরাচর প্রিপেইড মিটারের ওটিপি ২০ সংখ্যার বেশি আসে না, এরপর তা মিটারে তুলতে লাগে এক মিনিটের মতোন। কিন্তু, এবারে এমন কোড পাবেন তাই-ই বা কে জানত! সংখ্যার বাহুল্য দেখে রীতিমতো বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ অবস্থা হয় তাঁর। 

যেন সালাহউদ্দিনের বিদ্যুৎ সরবরাহকারীরা নতুন রেকর্ড করতে কোমর বেঁধে নেমেছেন। 

এতগুলো সংখ্যা ফোন থেকে পড়ে সঠিকভাবে মিটারের বোতাম চেপে প্রবেশ করা রীতিমতো এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। 

উপায়ান্তর না দেখে পুরো ওটিপি কোড প্রিন্ট করান সালাহউদ্দিন, এরপর একজনকে পাশে দাঁড়িয়ে সংখ্যাগুলো পড়তে বলেন। এভাবেই এক মিনিটের কাজটা করতে হয়েছে ঘণ্টাখানেক ধরে।  

এই ভোগান্তি শুধু সালাহউদ্দিনের বেলাতেই ঘটেনি।

২০২২ সালের তথ্যমতে, দেশে প্রিপেইড বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা ৫১ লাখ ৭ হাজার। সারাদেশ থেকে এসব গ্রাহকের অনেকেই ২০০ সংখ্যার বেশি ওটিপি কোড পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।

এনিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সিলেটের এক গ্রাহক অসীম তালুকদার লিখেছেন, “সাধারণ একটি মিটার রিচার্জ করার জন্য কেন ২৪০, ৩২০, ৩৫০ বা ৩৬০ ডিজিটের কোড লাগবে! ডিজিটালাইজেশনের নামে সাধারণ মানুষের হয়রানি এভাবে বাড়ানোর কাজ কেউ কীভাবে করতে পারে? তাঁদের কী কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই?”

এবিষয়ে আলাপকালে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ তরিকুল হক বলেন, “বিদ্যুতের ট্যারিফ বা দাম পরিবর্তন করা হলে, লোডশেডিং বাড়লে, নতুন সংযোগ বা অভ্যন্তরীণ কোনো পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় গ্রাহক এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন।”

তিনি জানান, প্রি-পেইড মিটার রুপান্তরের একটি পরিকল্পনা আছে তাঁদের– যার আওতায় প্রিপেইড মিটারকে রুপান্তর করা হবে অ্যাডভান্স মিটার ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এএমআই)-এ। আগামীতে বিল পরিশোধ করা তার ফলে অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। 

কিন্তু, সেবা উন্নত হওয়ায় অপেক্ষায় থাকা গ্রাহকরা এরমধ্যেই তিতিবিরক্ত। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির অধ্যাপক মো. ফজলুল করিম পাটোয়ারি বলেন, এই ধরনের হয়রানি একেবারেই অনাবশ্যক। 

“অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মোবাইল অ্যাপগুলোর মতোন এটাও খুবই সহজ একটা সিস্টেম করা যেত। বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো অহেতুক ডিজিটাল হয়রানি তৈরি করেছে। একজন প্রোগ্রামার হিসেবে আমি বুঝতে পারি না, আজকের ডিজিটাল দুনিয়ান কেন গ্রাহকদের ৩৪০টি ডিজিট চাপতে হবে। এটি বিদ্যুৎ বিভাগের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত”- তিনি বলছিলেন।
 
পাটোয়ারি আরো বলেন, সব নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে, সেই অনুযায়ী বিল পরিশোধের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ স্বল্প খরচেই একটি অ্যাপ তৈরি করতে পারে।  

আলী আহমেদ নামে চট্টগ্রাম নগরীর এক বাসিন্দা বলেন, “আমার শিক্ষাদীক্ষা তেমন নেই। এতগুলো সংখ্যা নিয়ে কী করব– তাই ভেবে দিশা পাই না। আমি নিজের মতো করে চেষ্টাও করেছি, কিন্তু দুইবার ভুল করার পর মিটার লক হয়ে যায়। এখন বিদ্যুৎ অফিস থেকে কেউ এসে সামান্য এই কাজটা কখন করে দিবে সেই অপেক্ষায় আছি।” 

সাভারের নামাগেন্ডা এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন বলেন, “আমার বাড়িতে বিদ্যুতের মিটার সিঁড়ির নিচে। আগে ২০ ডিজিটের কোড চেপে মিটার রিচার্জ করতাম। এখন আমাকে ২৪০টির বেশি সংখ্যার ওটিপি পাঠানো হচ্ছে। প্রথম দুইবার আমি ভুল কোড চাপি, তখন মিটার লক হয়ে যায়। আমার বাড়ির অন্য ভাড়াটেরাও একই সমস্যার মধ্যে আছেন।

“এটা কোন ধরনের ডিজিটালাইজেশন?” – প্রশ্ন রাখেন তিনি। 

পিডিবি’র একজন কর্মকর্তা এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন,  বছরের শুরুতে সব গ্রাহকের তথ্য হালনাগাদ করা হয়। 

“এতগুলো সংখ্যা ব্যবহারের কারণ, প্রতিটি সংখ্যা দ্বারা গ্রাহকের নাম, শ্রেণিবিভাগ ইত্যাদি তথ্য বোঝানো হয়। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর সার্ভারে এসব এনক্রিপটেড তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। নতুন কোনো তথ্য হালনাগাদ করতে নাহলে, তখন ২০টি ডিজিট দিয়েই রিচার্জ করা যায়।”

অবশ্য তিনি এটাও বলেন যে, বিদ্যুতের পরবর্তী দাম পরিবর্তনের আগপর্যন্ত এই সমস্যা আর হবে না। 

উৎপাদিত বিদ্যুতের সদ্ব্যবহার ও অপচয় রোধে স্বয়ংক্রিয় বিলিং সুবিধা সৃষ্টি করার জন্য ২০১১ সালে প্রি-পেইড মিটার চালু করা হয়। বর্তমানে প্রি-পেইড মিটার আরও আধুনিকায়ন করে অনলাইন স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত বছরের জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট বিদ্যুৎ গ্রাহক ৪ কোটি ৩১ লাখ। এদের মধ্যে ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ প্রি-পেইড মিটারের আওতায় রয়েছেন। আর দেশব্যাপী প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজ করছে বিদ্যুৎ বিতরণকারী ছয়টি কোম্পানি। 

এগুলো হলো- বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো)।

বর্তমানে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button