International

ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বললেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারী

আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা ও করণীয়’ শিরোনামের আলোচনা সভায় বক্তারা। ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হল, ফার্মগেট, ঢাকা, ১১ আগস্ট

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এক নারী জানালেন, দখল করা জমি উদ্ধার করতে গিয়ে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। অথচ বিচার পাননি। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীরা এমন নির্যাতনের বোঝা বয়ে বেড়ান। আজ শুক্রবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।

৯ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এই দিবস উপলক্ষে আজ রাজধানীর কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান হলে আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ। ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা ও করণীয়’ শিরোনামের সভায় বক্তারা বলেন, পাহাড়ে ও সমতলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ভূমি দখল করে নেওয়া হয়েছে। দখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার করতে গেলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পরিবারগুলোকে নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়, পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণের শিকার হতে হয়। পাহাড়ে বাঙালি সেটেলারদের হাতে সেখানের নারীরা ধর্ষণের শিকার হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। দেশ স্বাধীন হলেও পাহাড়ে এখনো সামরিক শাসন চলছে।

উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওই নারী জানান, ২০১৪ সালে তাঁদের ৪৮ বিঘা জমি সেখানকার বাঙালিরা দখল করে নেন। জমি উদ্ধারের আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি সক্রিয় ছিলেন। এ কারণে তাঁর পরিবারের সদস্যকে নির্যাতন করা হয় এবং তাঁকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করা হয়। আলোচিত ওই ঘটনায় পরবর্তী সময়ে তাঁদের জমি উদ্ধার হলেও আসামিদের তেমন কোনো শাস্তি হয়নি। ২৪ আসামিই এখন কারামুক্ত।

উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ঢাকা মহানগর শাখার সহসাংগঠনিক সম্পাদক অং শৈ সিং বলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে পাহাড়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো বাস্তবায়িত হয় না। সেখানে নারী ধর্ষণ-নিপীড়ন ও পাথর উত্তোলন চলছে।

আলোচনা সভায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। তিনি বলেন, নারীদের সম-অধিকার ও সমমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। সর্বস্বান্ত (ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে) করার যে ষড়যন্ত্র চলছে, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

সন্তু লারমা আরও বলেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের রক্তক্ষয়ী সব সংগ্রামে নারীরা সমানতালে ভূমিকা রেখেছেন। সেখানের নারীদের শিক্ষায় অংশ নেওয়া বেড়েছে এবং সচেতনতাও বেড়েছে। এখন নারীদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে নীতি ও আদর্শ নিয়ে পুঁজিবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে শামিল হতে হবে। রাজনীতিতে অংশ নিতে হবে। তা না হলে বৈষম্যমুক্ত সমাজে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন না কেউ। ২৫ বছরেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা আত্মনিয়ন্ত্রণের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত হবেও না সহজে। শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বার্থের জন্য যা যা করা দরকার, করছে।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে এখনো আদিবাসী জাতিগুলোর জাতিসত্তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকার নেই।’

ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হচ্ছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা; অর্থাৎ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজেদের মতো করে নিজেদের সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করা। অথবা রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে থেকে নিজেদের মতো করে বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের পরিচালনা করা।

আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সহকারী অধ্যাপক দীপ্তি দত্ত বলেন, আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আত্ম-সমালোচনাও প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন রাজনীতির ছায়ারাজনীতি নিয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার আন্দোলন সম্ভব নয়। শিক্ষাব্যবস্থাও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন, তাঁরা শিক্ষা শেষে আর ফিরে যান না। এই শিক্ষা তাঁদের ভূমি অধিকারের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করছে।

যে রাজনীতি বৈষম্যের ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে, সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লুনা নূর। সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের ঢাকা মহানগর শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুস্মিতা মরিয়ম বলেন, পাহাড়ে নানা জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় বৈষম্য রয়েছে। পাঁচ তারকা হোটেলের নামে, উন্নয়নের নামে জমি দখল করে ফেলা হয়েছে। পাহাড়ের বৈচিত্র্য ও মানুষের জীবিকা নষ্ট করা হয়েছে।

‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা ও করণীয়’ শিরোনামের আলোচনা সভায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হল, ফার্মগেট, ঢাকা, ১১ আগস্ট

‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা ও করণীয়’ শিরোনামের আলোচনা সভায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হল, ফার্মগেট, ঢাকা, ১১ আগস্ট

সভায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপনির্বাহী পরিচালক শাহনাজ সুমী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসভাপতি অজয় এ মৃ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজিম তিতিল, কাপেং ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক উজ্জ্বল আজিম ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা।

মুক্ত আলোচনায় তরুণ প্রজন্মের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী সুর্মি চাকমা ও প্রিয়ন্তী ত্রিপুরা আদিবাসী হিসেবে তাঁদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক মিনু মারিয়া ম্রং। স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সদস্য সুজয়া ঘাগ্রা। সভাটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের আরেক সদস্য তুলি লাবণ্য ম্রং।

সভায় জাতীয় সংসদে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ, নারী উন্নয়ন নীতিমালায় আলাদা অধ্যায় রাখাসহ আটটি সুপারিশ করা হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button