নির্বাচন বানচালে নতুন মিশন

নভেম্বরে ‘গণভোট’ চায় জামায়াত জামায়াতের আন্দোলন নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টার নামান্তর : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের দাবি অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা : ড. জাহেদ উর রহমান আলাদা গণভোটের মাধ্যমেই রিফর্মসের ওপর মত গ্রহণ করা উচিত : ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের
নির্বাচনী হাওয়ায় ভাসছে দেশ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া সর্বত্রই নির্বাচনের হাওয়া। ১২ কোটি ভোটার ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে এটি এখন অনেকটাই নিশ্চিত। প্রধান উপদেষ্টা দেশে-বিদেশে সবখানেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এটি পরিষ্কার করেছেন। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছে। নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার অনঢ় অবস্থানে থাকলেও এ নিয়ে তিনি শঙ্কার কথাও বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাতিসংঘে তাঁর বক্তব্যে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করলেও, নিউইয়র্কে মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এক সতর্কবার্তাও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কিছু শক্তি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, নির্বাচন যেন অনুষ্ঠিত না হয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরের ও বাইরের বিপুল অর্থ জড়িত। আগামী কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টার সে আশঙ্কার বেশ কিছু উপসর্গ ইতোমধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে। পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজনসহ বিভিন্ন দাবি, রিফাইন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় দেশি-বিদেশি চক্রের তৎপরতা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের আসামি করা নিয়ে সেনাবাহিনীকে উসকে দেয়ার অপচেষ্টা নির্বাচন বানচারের নতুন মিশন মনে করা হচ্ছে।
নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কয়েকজন উপদেষ্টা থেকে শুরু করে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসা ব্যক্তিরা ‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন’ আওয়াজ তোলেন। অতঃপর আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তোলা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি উঠানোয় নির্বাচনী পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। এখন যারা প্রশাসনে নিয়োগ-বদলি-টেন্ডার বাণিজ্য করছেন এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অনুগত ব্যক্তিদের বসিয়েছেন, তারা নির্বাচন বিলম্বের নানা ফন্দিফিকির করেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নত হয়নি এমন দাবি করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ দাবি করেন মানুষ এ সরকারকে ৫ বছর ক্ষমতায় দেখতে চায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। নির্বাচন যাতে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত না হয় সে জন্য নানান ইস্যুকে সামনে এনে অনৈক্য ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যখন আগামী ১৭ অক্টোবর ‘জুলাই সনদ’ সই করার ঘোষণা দিয়েছে; তখন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, নির্বাচনের আগে গণভোট, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিসহ কিছু দাবিতে মাঠ গরম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যে আন্দোলন শুরু করেছে, তা নির্বাচন বানচালের এক ষড়যন্ত্রের নামান্তর। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের শেষ দিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। সে সময় জামায়াতে ইসলামী পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এই পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি কার্যত দিল্লির এজেন্ডা বাস্তবায়নের নামান্তর। শেখ হাসিনা এবং সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা পালিয়ে গেলেও এখনো আওযামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা দেশেই রয়েছেন। ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা বর্তমান ভোটারের ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ। পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে অন্য ব্যানারে আওয়ামী লীগ ভোট করে ২০ শতাংশ ভোট পেলে এমনিতেই ৬০টি আসন পাবে। ভারতের এই নীল নকশার ফাঁদে পা দিয়ে জামায়াত-ইসলামী আন্দোলনের মতো দলগুলো পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে মাঠ গরম করার চেষ্টা করে। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে ভোট হবে না নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয়ায় এখন জামায়াত পিআর ইস্যু থেকে কিছুটা সরে এসেছে। এখন দলটি জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থাৎ আগামী নভেম্বরের মধ্যে গণভোটের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। এটি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে বানচালের নতুন মিশন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আগামী নির্বাচনকে পেছানোর জন্য জামায়াতে ইসলামী সেই শুরু থেকে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ জামায়াত এবং অন্যান্য নামে মাত্র কয়েকটি দল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় যে ক্ষমতা ভোগ করছে, তা তারা দ্রুত হারাতে চায় না। এ জন্য তারা কখনো পিআর কখনো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে অনৈক্য ও অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এতদিন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার ছিল। এখন যখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে, তখন তারা নতুন দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। এখন তাদের দাবি হচ্ছে- সংসদ নির্বাচনের আগে নভেম্বরের মধ্যে গণভোট করতে হবে। যে দাবি আদৌ পূরণ হওয়ার মতো নয়। একটা ভোট করতে রাষ্ট্রের অনেক টাকা খরচ হয়। সেটা এই মুহূর্তে করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে আগামী সংসদ নির্বাচনের সাথে গণভোট করার সিদ্ধান্তই প্রায় চূড়ান্ত। এ অবস্থায় জামায়াতে ইসলামী নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের যে দাবি তা একটা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা বলেই মনে হয়।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী নভেম্বরেই গণভোট চেয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে। গতকাল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে করে জামায়াত এ প্রস্তাব দিয়েছে। বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা বলেছি গণভোট আলাদা হতে হবে। কারণ দুটি বিষয়। একটা হচ্ছে- আমাদের কতগুলো রিফর্মস আছে। এটা ইলেকশন যখন হোক ইলেকশন যেভাবে হোক তার বাইরে এটা জাতির জন্য একটা স্থায়ী রিফর্মসের বিষয়। যেহেতু এটা একটা আলাদা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলাদা গণভোটের মাধ্যমেই এটার ওপর মত গ্রহণ করা উচিত। এটা আমরা জোর দিয়েই বলেছি। এক্ষেত্রে যে প্রস্তুতি দরকার আমরা রিকোয়েস্ট করেছি যদি ন্যাশনালি সিদ্ধান্তটি হয় যেটা আলাদাভাবে হবে যেটা আমরা চাচ্ছি। কোনো কারণে ইলেকশন যদি কোনো জায়গায় স্থগিত হয়ে যায় তাহলে এটা স্থগিত হয়ে যাবে মানে কোনো রেজাল্ট আসবে না। কিন্তু দুটি একেবারে ভিন্ন ন্যাচার একটা হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন জনপ্রতিনিধি করার জন্য আর এজন্য সবার জন্যই একটা রিফর্ম জরুরি। যেহেতু ন্যাচার ভিন্ন আমরা স্পষ্ট সরকারকে বলেছি, কমিশনকে বলেছি। ইলেকশন কমিশনে আমরা বলে আসছি যে এটা আলাদা করার জন্য।
জামায়াতে ইসলামীর এসব বিষয় নিয়ে আন্দোলন নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচন না হয় তাহলে এ নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলেও তিনি মনে করেন। গত ১২ অক্টোবর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ের মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, পিআর পদ্ধতির দাবিতে আন্দোলনের লক্ষ্যই হচ্ছে নির্বাচন বিলম্বিত করা, যা জনগণ গ্রহণ করবে না।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আগামী নভেম্বরে গণভোটের দাবি কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে সর্বমহলে প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। এ সময়ে মধ্যে গণভোট আয়োজনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কতটুকু প্রস্তুত তাও ভেবে দেখতে হবে। নির্বাচন কমিশন আগামী ফেব্রয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। এ অবস্থায় সংসদ নির্বাচনের বাইরে ইসি ‘গণভোট’ বাস্তবায়নে কতটুকু সক্ষম। এবার ১২ কোটি ৬৩ লাখেরও বেশি ভোটারের সংসদ নির্বাচনে থাকবে ৪০ হাজারেরও বেশি ভোটকেন্দ্র। সেখানে ভোটকক্ষ থাকবে আড়াই লক্ষাধিক। এছাড়া প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোটের আয়োজনও রয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এ সংসদ নির্বাচনে লোকবল নিয়োজিত থাকবে ১০ লাখেরও বেশি। একটি নির্বাচন আয়োজনের এই যদি হয় প্রস্তুতি এবং খরচ সেটা এই অল্প সময়ের মধ্যে করা কি সম্ভব? নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানের মাছউদ বলেন, ‘গণভোট নির্ভর করছে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর। এটা রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, সরকারের ব্যাপার। সরকার যদি মনে করে গণভোট করবে, তাহলে আমরা গণভোট আয়োজন করবো ইনশাআল্লাহ। তবে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে রাষ্ট্রের বড় ব্যয় সাশ্রয় হবে।







এখানে তেমন দুটি দল মিলে নির্বাচন বিলম্ব করার খেলা চালাচ্যূত! প্রথমে পিআর পদ্ধতির কথা বলছে, পরে গণভোটের দাবি নিয়ে। কোন্ দিকে যাবেন তা নিশ্চিত নয়, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মনে হচ্ছে তাঁদের সময় বিলম্ব। আমরা কি ভোট দিতে যাচ্ছি তা না জেলেই নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে? আর জামায়াতের মতে পিআর আলাদা গণভোট দিতে হবে? হাসি হই না দেখে ভাবি যে আসুন নিজেদের নির্বাচন করে নিজেদের সময় করুন!deltarune final prophecy