Bangladesh

মানব পাচার চক্রের হটস্পট মাদারীপুর

দক্ষিণাঞ্চলের জেলা মাদারীপুর। এই অঞ্চলের মানুষের জীবিকার প্রধান খাত কৃষি। তবে মাদারীপুরে অসংখ্য প্রবাসী রয়েছেন। প্রায় প্রত্যেক ঘরে এক-দু’জন করে প্রবাসী। ইউরোপ- আমেরিকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন তারা। প্রবাসে পাড়ি দেয়ার পর ভাগ্যের চাকা বদলে যাচ্ছে মানুষের। কয়েক বছরের মধ্যেই টিনের ঘর থেকে হচ্ছে অট্টালিকা। এসব প্রবাসীর মধ্যে অনেকেই অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আর এই লোভেই পড়ছে মাদারীপুরের মানুষ। বিদেশে গিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে বেছে নিচ্ছে ভয়ঙ্কর পথ।

বিজ্ঞাপন অবৈধ পথে পাড়ি দিচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এই সুযোগে মানব পাচার চক্রও হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাষাবাদ করে জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়তে হয় এই অঞ্চলের মানুষের। উচ্চশিক্ষা ও পর্যাপ্ত শিল্পখাত না থাকায় ভাগ্যের চাকা ঘুরে না দক্ষিণাঞ্চলের এই জনপদের মানুষের। অধিকাংশ কিশোরই প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়েই কর্মজীবন শুরু করে দেয়। তাদের বয়স ১৮ হলেও বিদেশ যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দেন অভিভাবকরাও। জমিজমা বিক্রি করে সন্তানকে বিদেশ পাঠাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় মানব পাচার চক্র। গ্রামের সরল মানুষকে ইউরোপে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। মাদারীপুর মানব পাচার চক্রের হটস্পট। প্রতিটি গ্রামেই গোপনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই চক্রের হোতা। স্থানীয়দের কাছে তারা দালাল নামে পরিচিত। এসব দালালদের বিশ্বাস করেই সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন মানুষ।

মিরাজ মোল্লার ছেলে মিরাপ মোল্লা। বেকার সময় পার করছিলেন। তার গ্রামের অনেকেই প্রবাসী। আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল। ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে মিরাপও ইউরোপে পাড়ি জমাতে চান। তাই যোগাযোগ করেন এমদাদ বেপারীর সঙ্গে। এমদাদ মাদারীপুর সদর উপজেলার কুমারখালী গ্রামের বাসিন্দা। মিরাপ একই জেলার পেয়াপুর গ্রামে থাকেন। মানুষকে অবৈধ পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান এমদাদ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০২২ সালে লিবিয়া যান মিরাপ। দেড় বছর সেখানে ছিলেন তিনি। এই দেড় বছরে লিবিয়া থেকে নৌপথে চারবার ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়েছেন প্রতিবারই। ধরা পড়ার পরের দিনগুলো ছিল বিভীষিকাময়। মিরাপ মোল্লার বাবা মিরাজ মোল্লা জানান, ধরা খাওয়ার পর স্থানীয় দালাল চক্র এক ঘরে বন্দি করে রাখে মিরাপকে। সেখানে ঠিকমতো খাবার দিতো না। পানি দিতো না। করা হতো মারধর। গোসল না করে শরীরে ঘা হয়ে গেছে মিরাপের। মিরাজ বলেন, নৌপথে পাড়ি দেয়ার সময় বাংলাদেশের দালালরা লিবিয়া চক্রকে জানিয়ে দিয়ে নিজেরাই ধরিয়ে দিতো। পরে আমাদের থেকে টাকা নিয়া ওরাই ছুটাইতো। দেড় বছরে তিনবার ধরিয়ে দিছে। শেষে মাফিয়ার কাছে ধরিয়ে দিছে। এই বছর মার্চ মাসে মাফিয়া ধরছে। পরে অন্য দালালের মাধ্যমে ১৩ লাখ টাকা দিয়া ছাড়ানো লাগছে। 

লিবিয়া দিয়ে ইউরোপ যেতে তিন ধাপে দালাল চক্রকে টাকা দিয়েছে মিরাপ মোল্লার পরিবার।  শুরুতে নগদ ৫ লাখ টাকা দিয়েছিল। লিবিয়া পৌঁছানোর পর নৌপথে ইউরোপ যেতে ব্যাংকের মাধ্যমে সাড়ে ১১ লাখ দেয়া হয়। কিন্তু তাও ইউরোপে যেতে পারেনি। মাফিয়ার হাতে ধরা খাওয়ার পর আবার ১৩ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনে ফের ইতালি পাঠানো হয়। তিন মাস হলো ইতালি পৌঁছেছেন মিরাপ। বাবা মিরাজ বলেন, ছেলেকে এক দালাল আরেক দালালের কাছে বেচে দেয়। নৌপথে যাওয়ার সময় তিনবার আটকাইছে। অনেকদিন জেল খাটছে। মাফিয়া নেয়ার পর তার ৩-৪ মাস খবর ছিল না। এমদাদের মাধ্যমে এই গ্রামের অনেক মানুষ গেছিলো। একটা লোকও পার করতে পারে নাই। টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়েছিল। পরে র‌্যাব তাকে ধরছে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিবিয়া দিয়ে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মাদারীপুরের সক্রিয় দালাল চক্র। এসব দালাল চক্র মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রামের সরল মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলছে তারা। ইতালি, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে তারা জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছেন। এসব দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে মানুষ তাদের জমিজমা পর্যন্ত বিক্রি করতে হচ্ছে। ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে প্রথমে পাঁচ থেকে ৬ লাখ টাকা নিয়ে তারা বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে লিবিয়া পাঠায়। এরপর সেখান থেকে নৌপথে ইউরোপের দেশ ইতালি পাঠানোর কথা বলে। তবে এরমধ্যেই বিপত্তিতে পড়তে হয় মানুষকে। নৌপথে পাড়ি দিতে গিয়ে স্থানীয় মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়ে তারা। ভুক্তভোগী পরিবাররা জানায়, কৌশলে আরও টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য এই মাফিয়া চক্রের কাছে ধরিয়ে দেয় দালাল চক্রই। মাফিয়ারা তাদের লিবিয়ার বিভিন্ন টর্চার সেলে নিয়ে বন্দি করে রাখে। সেখানে তাদের করা হয় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন। এছাড়া পানি ও খাবার দেয়াও বন্ধ করে দেয়। খাবার ও পানির অভাবে তারা অসুস্থ হয়ে যায়। ওই টর্চারসেল থেকে ছাড়ানোর জন্য পরিবারের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করে দালাল চক্র। এরপর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়। এভাবে ফের নৌপথ দিয়ে পাড়ি দিতে গিয়ে একাধিবার মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়তে হয় ভুক্তভোগীদের। বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা খোয়াতে হয় তাদের। ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপ পাঠানোর সময় নৌকাডুবিতে অনেক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন ভূমধ্যসাগরে। কিছুক্ষেত্রে এসব নির্যাতন সহ্য করে কেউ কেউ ইউরোপের দেশে পৌঁছাতেও পারেন।

মিরাপের মতো এমদাদের হাত ধরে একই পথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন মিঠু। তার পরিণতিও হয় একই।  শুরুতে সাড়ে ৮ লাখ টাকার চুক্তি হয় লিবিয়া দিয়ে ইতালি নেয়ার। কিন্তু টাকা পাওয়ার পর আর তাকে ইতালি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। চাওয়া হয় ৫ লাখ টাকা। সে টাকা নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের সঙ্গে। এদিকে লিবিয়ায় আরেক চক্রের কাছে আটক ছিল মিঠু। সেখানে তাকেও করা হতো নির্যাতন। সেখান থেকে সবুজ নামের আরেক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় মিঠুকে। সবুজও তাকে নির্যাতন করতো। তাকে লিবিয়া পাঠানোর কথা বলে আরও ১০ লাখ টাকা দাবি করলে সবুজকে সেই টাকাও দেয় পরিবার। কিন্তু এরপরও মিঠুকে ইতালি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। 

মিঠুর বাবা আব্দুল অহেদ হাওলাদার বলেন, লিবিয়ায় ছেলেকে পুলিশ ধরে। পরে ৩ মাস আর কোনো খোঁজ ছিল না। সবুজ ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার কথা বলে আরও ৩ লাখ টাকা নিলো। পরে তাকে আর কোনো টাকা দেই নাই। সাড়ে ৭ লাখ টাকার চুক্তিতে আবার ইতালি পাঠানোর জন্য পিয়ারপুরের দালাল বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করি। নগদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা নিয়ে আর যোগাযোগ করেনি বাবু। শেষে জমি-জমা বেঁচে জাহাঙ্গীর নামের আরেক দালালকে আরও সাড়ে ৭ লাখ টাকা দেই। সেই দালালের মাধ্যমে ছেলে ইতালি যেতে পারছে। তিন মাস ধরে ইতালি আছে। কিন্তু ছেলে এখনও অসুস্থ। তিনি বলেন, ছেলের খাওয়ার টাকা ছিল না। মোবাইল বিক্রি করে খাওয়ার টাকা পাঠাইছি। সেই টাকাও দালাল দেয় নাই।

সম্প্রতি মাদারীপুরে মানব পাচার চক্রের মূল হোতা এমদাদ বেপারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এমদাদ বেপারীর প্রলোভনের শিকার হয়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয় অনেক যুবক। এমদাদ ইতালি প্রবাসী সজীব মীরের কাছে যুবকদের বিক্রি করে দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুরের দালাল চক্রের একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছেন। এরমধ্যে বড়াইলবাড়ী গ্রামের জামাল খাঁ, শ্রীনাথদি বাজিতপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, ধুরাইল ইউনিয়নের চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাস তালুকদার, হোসেনপুরের জাকির হোসেন, টেকেরহাটের লিয়াকত মেম্বার, কদমবাড়ীর রবিউল ওরফে রবি, শাখারপাড় গ্রামের কামরুল মোল্লা, এমরান মোল্লা, আমগ্রাম ইউনিয়নের কৃষ্ণার মোড় এলাকার শামীম ফকির, সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের শহিদুল মাতুব্বর ও সিরাজ মাতুব্বর। এ চক্রের সঙ্গে রয়েছে বেশকিছু নারী দালাল। তারা কমিশনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কিশোর-যুবকদের সংগ্রহ করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মানব পাচারের মামলার সংখ্যা দুই হাজার ৭৪০টি। তদন্তাধীন রয়েছে ৫৪৫টি মামলা। সব মিলিয়ে মামলা পেন্ডিং রয়েছে তিন হাজার ২৮৫টি। এসব মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ৩১ হাজার ৭৮৮ জনকে। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৪ হাজার ৬২২ জনকে। মাদারীপুর পুলিশ জানায়, জেলায় ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত অর্থাৎ ১ বছরে ৭৪টি মানব পাচার মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬৮ জন আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, যারা এই ধরনের ভুক্তভোগী তারা দেশে ফেরত এসে মানবপাচার আইনে মামলা করে। মামলার প্রেক্ষিতে আমরা তদন্ত করি। এরপর অনুসন্ধানে জানা যায় অনেকেই অনেক করুণ পরিণতির শিকার হন। বিশেষ করে অনেকেই মানবেতর জীবন-যাপন করেন। অবৈধ প্রক্রিয়ার সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়েও অনেক বেশি টাকা খরচ যায়। আবার তাদের জীবনের ঝুঁকিও থেকে যায়। তিনি বলেন, মানব পাচার ঠেকানোর জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর কাজ হলো গ্রেপ্তার করা। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মসংস্থানের জন্য এগিয়ে আসা দরকার। 
এই দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য মাদারীপুরে বেশি কিনা জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, মাদারীপুরের ইউরোপে অনেক অনেক কর্মসংস্থানে রয়েছে। এইজন্য মনে হতে পারে মাদারীপুরে দালাল চক্র একটু বেশি। তবে এখানে দালাল চক্র বেশি না। অবশ্য আমাদের পরামর্শ থাকবে বৈধ প্রক্রিয়ায় মানুষ যেন বিদেশে যায়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button