মার্চে দুর্ভিক্ষ না এলেও রোজা শুরু, দ্রব্যমূল্য নাগালে থাকবেতো?
২০২৩ সালের ০৮ই ডিসেম্বর। তারিখটি গত বছরের হলেও সময়টি মাত্র আড়াই মাস আগের। তার মাত্র এক মাস পরই (০৭ জানুয়ারি, ২০২৪) দেশে বহুল আলোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ০৮ই ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ সফরে গিয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকা কোটালীপাড়ায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “সামনে নির্বাচন। বিএনপি চিন্তা করেছিল নির্বাচন হবে না। এখন নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে। একসময় বলেছিল নির্বাচন হতে দেবে না। উসকানি আছে যে নির্বাচন ঠেকাও। নির্বাচনের শিডিউল হয়ে গেছে। এখন তারা মনে করছে নির্বাচন হয়েই যাবে।
তাই তারা মার্চের দিকে দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। এটা হচ্ছে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। এটা শুধু দেশের নয়, বাইরের দেশেরও পরিকল্পনা। যেভাবেই হোক দুর্ভিক্ষ ঘটাতে হবে” (কালের কন্ঠ, ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৩)।
ওইসময় অনেকেই নির্বাচন ‘হবে না’ বা ‘হতে দেবো না’ বলে কানাঘুষা কিংবা ঘোষণা করলেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রথম অংশ এক মাস পর ঠিক প্রমাণিত হয়েছে- নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ মার্চের দিকে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে- বিষয়টি আমলে নিলে ফেব্রুয়ারির একেবারে শেষের দিকে এসে সচেতন মানুষের দুঃশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। বিশেষ করে সরকারের একেবারে উচ্চ মহল থেকে যখন বারবার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বলা হচ্ছে যে বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে এবং সে জন্য সরকার দায়ী নয়।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারিও গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “ডিম লুকিয়ে রেখে দাম বাড়ানো হয়েছে। যারা সরকার উৎখাতের জন্য আন্দোলনকারী তাদের হাত রয়েছে এগুলোর পেছনে। এর আগে পেঁয়াজের খুব অভাব। পরে দেখা গেলো বস্তা বস্তা পচা পেঁয়াজ পানিতে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এদেরকে ধরে গণধোলাই দেয়া উচিত। সরকার এমন করলে মানুষ বলবে সরকার করছে এগুলো, এর থেকে ভালো জনগণ যদি এগুলোর প্রতিকার করে তাহলে কেউ কিছু বলতে পারবে না” (দেশ রূপান্তর, ২৩ ফেব্রুয়ারি)।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ঠিক পরদিনই ক্ষমতাসীন দল- আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একবারে খোলামেলাভাবেই স্বীকার করেছেন “বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে”। সেই সাথে তিনি এটাও বলছেন যে, এই অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সরকার দায়ী নয়” (ইত্তেফাক, ২৪ ফেব্রুয়ারি)।
মার্চ মাস যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তখন পরপর দুই দিন ক্ষমতাসীন দলের একেবারে শীর্ষ দুই ব্যক্তির এমন বক্তব্যের সাথে ‘দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটতে পারে’ বলে নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যৎবাণীকে মিলিয়ে সচেতন মহলের কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাজ পড়েছে। কিছুদিন আগেও ‘রাজনীতি’ যেখানে ছিল টক অফ দ্য কান্ট্রি, সেই স্থান এখন দখল করেছে ‘দেশের অর্থনীতি’।
মানুষের এই দুঃশ্চিন্তার পেছনে যে যৌক্তিক কারণ রয়েছে তা বোঝা যায় জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান এবং একাদশ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকেও। ওবায়দুল কাদের যেদিন ওই বক্তব্য রাখছিলেন সেদিনই দলের এক বর্ধিত সভায় সভাপতির বক্তব্যে রওশন বলেন, “অর্থনৈতিক অনেক অশনিসংকেত শোনা যাচ্ছে। সরকার যদি তা মোকাবেলা করতে না পারে তাহলে দেশে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে” (কালের কন্ঠ, ২৪ ফেব্রুয়ারি)।
সরকারের তরফে দেশের অর্থনীতি নিয়ে শংকার কথা যেমন প্রায়ই বলা হচ্ছে, তেমনি সরকারবিরোধী বলে পরিচিত রাজপথে থাকা নেতারাও বারবার এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করছেন। এসবের পাশাপাশি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ক্রমবর্ধমান হওয়ার প্রেক্ষিতে সচেতন মহল থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষও দেশের অর্থনীতি নিয়ে নিজেদের আশঙ্কার কথা নানা মাধ্যমে প্রকাশ করছেন।
সম্প্রতি ডয়চে ভেলেতে সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে। তার প্রশ্নটি ছিলঃ অনেকেই এমন আশঙ্কা করছেন যে- বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে আছে যেহেতু বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ আছে, ব্যাংকিং খাতে নানা ধরনের অব্যবস্থা আছে৷ আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব ভঙ্গুর বা মারাত্মক কোনো চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে? সরকারও এই চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে। কিন্তু, তারা করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বলে যে, সারা বিশ্ব (এই অবস্থায়) পড়েছে, আমরাও পড়েছি। আপনি এটা কিভাবে দেখেন? সারা বিশ্বের এবং বাংলাদেশের অবস্থাকে কিভাবে তুলনা করেন?
এর জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “সারা বিশ্বের অর্থনীতি যেটা…বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, এটা সবাই যেমন বলছে সেভাবে আমাকেও বলতে হবে। কিভাবে সমাধান হবে সেটারও বহু উপায় বলা হচ্ছে। সরকার সেটা নির্ধারণ করবেন। তাহলে হয়তো অগ্রসর হওয়া যাবে।”
এদিকে, এক সপ্তাহেরও কম সময়ে মার্চ মাস আসছে। এই মার্চেই আবার পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে বরাবরের মতোই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। বরাবরের মতো এসব সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করে দ্রব্যমূল্য না বাড়িয়ে তা যেনো অন্তত নাগালের মধ্যে থাকে, সাধারণ মানুষের এটাই প্রত্যাশা।