সংসদে সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজনীয়তা আর কত দিন?
নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আজ থেকে ৫২ বছর আগে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখা শুরু হয়েছিল। অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় পার হলেও এভাবে নারী ক্ষমতায়ন কতটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে, তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে।
তবে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন বাড়লেও সাধারণ আসনে নির্বাচিত হয়ে আসা নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা আগের জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় কমেছে।
এবার ৩০০ আসনের মধ্যে নারীরা জিতেছে মাত্র ২০টিতে। একাদশ সংসদে এই সংখ্যা ছিলো ২২ জন। এমনকি গত চারটি নির্বাচনে এই সংখ্যা ১৮ থেকে ২২ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এমন অবস্থায় সব প্রক্রিয়া শেষে রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দ্বাদশ সংসদের জন্য সংরক্ষিত ৫০ আসনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত নারী এমপিদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন। আগামী মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হবে। এদের মধ্যে ৪৮ জনই আওয়ামী লীগের, আর বাকি দুজন জাতীয় পার্টির।
এবার আওয়ামী লীগ থেকে এমন তিনজনকে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, যাদের কেউ কেউ মন্ত্রী ছিলেন, ছিলেন সাধারণ আসনের সংসদ সদস্যও। দলীয় মনোনয়ন পেয়েও কেউ কেউ জিততে পারেননি, পরবর্তীতে তাদেরই বানানো হচ্ছে সংরক্ষিত আসনের সংসদ।
সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও দুজনকে মনোনয়ন দিয়েছে, যারা সাধারণ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও পরাজিত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদ সদস্য হওয়া অনেকের পারিবারিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। শীর্ষ নেতারা তাদের আত্নীয়-স্বজনদের সংসদে নিয়ে আসছেন এই প্রক্রিয়ায়।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দাবি, সংরক্ষিত নারী আসনে কাউকে পুর্নবাসন করা হয়নি। যাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তাদের সব যোগ্যতাই বিবেচনা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, ‘মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কমিটমেন্টকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। যারা এ নিয়ে সমালোচনা করছে সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। তবে আওয়ামী লীগ সবদিক বিবেচনা করেই মনোনয়ন দিয়েছে।’
আইন বিশ্লেষক শাহদীন মালিকের মতে, ১৯৭২ সালে যে প্রেক্ষাপটে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন চালু হয়েছিলো এখন সেই প্রয়োজনীয়তা খুব একটা নেই। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে হলে এখন সাধারণ আসনেই নারী মনোনয়ন বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য প্রচলিত আইনের সংস্কারেরও তাগিদ দিচ্ছেন তারা।
সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন কেন?
১৯৭২ এর সংবিধানে ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা হয়।
তখন একটি উপধারায় এ ঘোষণাও দেওয়া হয় যে ‘সংবিধান প্রবর্তন হইতে ১০ বৎসরকাল অতিবাহিত হওয়ার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ’ ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত ১৫টি আসন কেবল নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং তাঁরা আইন অনুযায়ী পূর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন।
তখনকার আর্থ-সামাজিক অবস্থায় ১০ বছরের জন্য ১৫টি নারী আসন সংরক্ষিত রাখা এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পরোক্ষ ভোটে নির্বাচন খুবই স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত ছিল।
সংবিধানপ্রণেতারা ধারণা করেছিলেন, পরবর্তী দশ বছরে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে, তখন আর সংরক্ষিত নারী আসন রাখার প্রয়োজন হবে না। নারীদের অনেকেই সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।
পঁচাত্তরের পর সামরিক শাসনের মধ্যে সংবিধানের এই ধারায় পরিবর্তন আনা হয়।
সামরিক ফরমান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র ৬ নম্বর সংশোধন আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা ‘১০ বৎসরকালের’ জায়গায় করা হয় ১৫ বছর এবং নারীদের সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৩০।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘১৯৭২ সালে যখন এই আইনটি তৈরি করা হয় তখনকার প্রেক্ষাপটে তা ছিল যুক্তিসঙ্গত ও সময়োপযোগী। এখন এটা লোভ দেখানো আর আত্নতুষ্টির বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে কমে গেছে।’
২০১৮ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বাড়ানো হয়।
সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিতদের কার্যপরিধির ব্যাপ্তি বা দায়িত্বের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে আলাদাভাবে উল্লেখ নেই। সংবিধানে শুধু বলা আছে, সংরক্ষিত আসন থাকতে হবে, সেটির সংখ্যা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন করা হয়েছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রথমে সংরক্ষিত ও পরে সাধারণ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সানজিদা খানম। দ্বাদশ সংসদে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েও জিততে পারেননি। কিন্তু আবারও তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সংরক্ষিত আসনে।
সানিজদা খানম বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী যে ৫০টি আসন নারীর জন্য সে অনুযায়ী নারী তার ক্ষমতায়নে কাজ করবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করাই সংরক্ষিত আসনের উদ্দেশ্য।’