স্বজন যখন ভয়ংকর খুনি
নানা কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পারিবারিক কলহ। দুর্বল হয়ে পড়ছে সম্পর্ক। অনুভূতি আর ভালোবাসার জায়গাও কমছে। শিথিল হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। মানুষ হারাচ্ছে ধৈর্য। এসব কারণে স্বজনকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। স্বামী হত্যা করছে স্ত্রীকে, মা হত্যা করছে সন্তানকে। কখনও আবার স্ত্রী-সন্তানকে হত্যা করে গৃহকর্তার আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনায় অনিরাপদ হয়ে পড়ছে আপন ঘর ও স্বজন।
গত ৩০ জানুয়ারি তেমনই একটি ঘটনা ঘটে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায়। এদিন উপজেলা সদরের বারোয়ারি বটতলা মহল্লার একটি বাসা থেকে তিনজনের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হলেন ওই এলাকার বিকাশ চন্দ্র সরকার, তাঁর স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার ও তাদের একমাত্র কন্যা ১৫ বছরের পারমিতা সরকার তুষি। দ্রুত সময়ে এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে পুলিশ জানায়, ব্যবসা ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে মামা বিকাশ চন্দ্রকে সপরিবারে হত্যা করে আপন ভাগনে রাজীব কুমার ভৌমিক।
গ্রেপ্তারের পর সে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, কৃষিকাজের পাশাপাশি ব্যবসা করতেন বিকাশ। রাজীবের খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসায় তিনি ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। ব্যবসার লভ্যাংশসহ ২৬ লাখ টাকা বিকাশকে পরিশোধ করে সে। এ জন্য তাকে ৬ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ করতে হয়েছিল। এর পরও ৩৫ লাখ টাকা দাবি করছিলেন বিকাশ। এ নিয়ে মামা-ভাগনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। টাকার দাবিতে বোনের (রাজীবের মা) সঙ্গেও অসদাচরণ করেন বিকাশ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মামা, মামি ও মামাতো বোনকে হত্যা করে রাজীব।
এর ঠিক তিন দিন পর ঘটে আরেকটি ভয়ংকর ঘটনা। ২ ফেব্রুয়ারি সকালে নীলফামারী জেলা সদরের চড়াইখোলা ইউনিয়নের দাড়োয়ানী বন্দর বাজার গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে তহুরা বেগম, তাঁর শিশুকন্যা আয়েশা আক্তার ও জারিন আক্তারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গলাকাটা অবস্থায় বাড়ির উঠান থেকে উদ্ধার করা হয় গৃহকর্তা কাঠ ও আসবাব ব্যবসায়ী রাশিকুল হক মোল্লা ওরফে বাবুকে।
পুলিশ, স্বজন ও স্থানীয়দের ধারণা, ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল রাশিকুল। একসময় তার স মিল ও আসবাবের ব্যবসা ছিল। লোকসানের কারণে এসব বিক্রি করে দিতে হয়। এক পর্যায়ে হতাশা থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যার পর গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করে সে।
রাশিকুলের অবস্থা সংকটাপন্ন; পুলিশি পাহারায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। গত ২৭ জানুয়ারি ঘটা কুষ্টিয়ার ঘটনাটিও ছিল আঁতকে ওঠার মতো। এ দিন শহরের মঙ্গলবাড়িয়া এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে বাবা রেজাউল করিম মধু ও তাঁর সাত বছরের ছেলে মুগ্ধের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, ছেলেকে হত্যার পর গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন রেজাউল।
তাঁর স্ত্রীর ভাই বিপু ইসলাম সমকালকে জানান, পেশায় স্বর্ণকার রেজাউল সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। প্রেম করে ২০১৫ সালে বিপুর বোন শেফালীকে বিয়ে করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় স্বজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি শেখ মো. সোহেল রানা জানান, রেজাউল ধর্ম পরিবর্তন করলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম বদলাতে পারছিলেন না। এ কারণে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি। এ ছাড়া ভাইবোনসহ স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় হতাশায় ভুগছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, এসব কারণে ছেলেকে হত্যার পর রেজাউল আত্মহত্যা করেন।
এদিকে ৩০ জানুয়ারি নড়াইলের লোহাগড়া থানার লঙ্কারচর গ্রামের পলি বেগম তিন শিশুকন্যাকে বিষ পান করিয়ে নিজেও পান করেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই মেয়ে মারা যায়। অপর মেয়ের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শারীরিকভাবে শঙ্কামুক্ত হলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন পলি। তাঁর স্বজনের দাবি, শাশুড়ির অত্যাচার সইতে না পেরে তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তবে পুলিশ ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলছে, পলির মাথায় সমস্যা আছে। বিভিন্ন সময় তাঁকে চিকিৎসা করানো হয়েছে।
সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের মধ্যে সহনশীলতা কমছে। সবাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। এতে দুর্বল হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। তাই পারিবারিক হত্যাকাণ্ড কমাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অটুট রাখতে হবে পারিবারিক বন্ধন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবার কাঠামো এক ধরনের আর্থিক জটিলতা ও দাম্ভিকতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জীবনমান যেভাবে বজায় রাখা দরকার, অর্থনৈতিক কারণে পরিবার সেই মান বজায় রাখতে পারছে না। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। ব্যক্তির সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক খুবই দুর্বল হচ্ছে এবং পারিবারিক সম্পত্তি-সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব বাড়ছে। প্রযুক্তির কারণে মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে মানুষের অনুভূতি এবং ভালোবাসা অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সহিসংতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার এগুলো অন্যতম কারণ। যেসব সমস্যা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হচ্ছে, সেদিকে রাষ্ট্রীয় নজর রাখা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, পারিবারিক কলহের পেছনে নানা কারণ থাকে। মানুষের নেতিবাচক পরিস্থিতি সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করে। পারিবারিক সম্পর্কের সংকট সমাধানের যে শিক্ষা, যে মানসিকতা– তা আমাদের পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে অনেকের নেই। পারিবারিক কাঠামো ব্যবস্থা ধরে রাখতে হলে পরিবার টিকে থাকে এমন আচরণগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে শৈশব থেকেই মানুষকে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি পরিবারকে গুরুত্ব দিতে হবে, সম্পর্কের যত্ন নিতে হবে।
পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, মানুষের ধৈর্য কমে যাচ্ছে। কোনো সমস্যা তৈরি হলে সেটি মোকাবিলা না করে অস্থির হয়ে পড়ছে। পারিবারিক সমস্যা পারিবারিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে; প্রয়োজনে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। একজনের সমস্যায় আরেকজনকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে সহিংসতা কমে আসবে।