স্যালাইন সংকটে দিশাহারা রোগী: ♦ বিঘ্নিত ডেঙ্গু চিকিৎসা ♦ সংকট পুঁজি করে কালো ব্যবসা
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় অতি প্রয়োজনীয় আইভি স্যালাইনের (শিরায় প্রয়োগযোগ্য) সংকট কাটছেই না। হাসপাতাল থেকে বন্ধ স্যালাইনের সরবরাহ। ফার্মেসি থেকে ফার্মেসি ঘুরে ৮০-৮৫ টাকার একটি স্যালাইন কিনতে হচ্ছে ২৫০-৪০০ টাকায়। দুই মাসের বেশি সময় ধরে সংকট চললেও এখন পর্যন্ত এর সুরাহা হয়নি। আর এই দুই মাসেই ডেঙ্গুতে ঝরে গেছে ৭১২ জনের প্রাণ। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সম্প্রতি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ২০ লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে হঠাৎ কেন এমন সংকট তার ব্যাখ্যা মেলেনি সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর বা ওষুধ প্রস্তুতকারকদের থেকে। সংকটকে পুঁজি করে সাদা স্যালাইনের কালো ব্যবসায় নেমেছে হাসপাতালের কর্মচারী থেকে শুরু করে ফার্মেসিগুলো। হাসপাতালে মজুদ থাকলেও রোগীর স্বজনদের ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্যালাইনের নাম লেখা স্লিপ। সেই স্লিপ নিয়ে রোগীর স্বজনরা দৌড়ে বেড়াচ্ছেন ফার্মেসি থেকে ফার্মেসিতে। ফার্মেসিগুলো সংকট দেখিয়ে তিন-চার গুণ বেশি দামে বিক্রি করছে স্যালাইন। গতকাল মগবাজার থেকে শাহবাগে স্যালাইন খুঁজতে আসা মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘মা ডেঙ্গু আক্রান্ত। হাসপাতাল থেকে স্যালাইনের স্লিপ দেওয়া হয়েছে। কোথাও পাচ্ছি না। এখানে দুটি দোকানে পেয়েছি। ৪০০ টাকার নিচে কেউ বিক্রি করতে চাইছে না।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার নাকি প্রতি ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করছে। অথচ ৮০ টাকার স্যালাইন-ই দিতে পারছে না।’ এদিকে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় স্যালাইন সংকট আরও প্রকট হয়েছে বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে বাগেরহাট, পিরোজপুর, খাগড়াছড়ি, শেরপুর, যশোর, ফরিদপুর, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা ও সাতক্ষীরা জেলায় তীব্র স্যালাইন সংকট চলছে বলে জানা গেছে। ৫০০ শয্যার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন ১২০০-এর বেশি। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি থাকে ১৪০-১৫০ জন। ডেঙ্গু রোগীদের প্রত্যেককে প্রতিদিন দুটি করে আইভি স্যালাইন দিতে হয়। কিন্তু হাসপাতালে স্যালাইনের মজুদ থাকা সত্ত্বেও বাইরে থেকে উচ্চমূল্যে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। জানা যায়, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ৩ হাজার লিটার (পিস) স্যালাইন এসেছে। ১৭ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ওয়ার্ডের এক সপ্তাহের চাহিদা অনুযায়ী ৯০০ পিস স্যালাইন সরবরাহ করা হয়। বাকি ২১০০ পিস স্যালাইন এখনো গোডাউনে মজুদ থাকলেও সংকটের কথা বলে বাইরে থেকেই স্যালাইন কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীর স্বজন শরিফুল ইসলাম জানান, এখানে ভর্তির দিন থেকেই প্রতিদিন দুটি করে স্যালাইন বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে কোনো স্যালাইন দেওয়া হয়নি। চিকিৎসকরা রাউন্ডে এসে স্যালাইন দিতে বললে নার্সরা স্লিপ ধরিয়ে দেন। ফার্মেসি থেকে ৮৭ টাকার প্রতিটি স্যালাইন ২৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। খুলনা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই খুদা বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে শুধু ডেঙ্গু রোগীদের জন্য একদিনে ৩০০টি আইভি স্যালাইনের দরকার। এক সপ্তাহে দরকার ২১০০টি। কিন্তু পুরো হাসপাতালের রোগীর জন্য এক সপ্তাহে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯০০টি স্যালাইন। স্বজনদের দিয়ে বাইরে থেকে উচ্চমূল্যে স্যালাইন কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে জড়িতরা ফার্মেসিগুলো থেকে কমিশন পায়। অনেক সময় স্বজনদের দিয়ে ওষুধ কিনিয়ে সেটা আবার ফার্মেসিতে বিক্রি করে দেয়। যে স্যালাইনগুলো বরাদ্দ হয়েছে, সেগুলো কাগজে-কলমে রোগীদের দেওয়া হলেও বাস্তবে দেওয়া হয় কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলা হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়গুলোয় মোট ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪০০টি স্যালাইনের চাহিদার বিপরীতে মজুদ রয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৬২৬টি। এই সুযোগে ফার্মেসিগুলোতে রাখা হচ্ছে গলাকাটা দাম। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের ফার্মেসি মালিকরা জানান, তাদের দোকানে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০টি স্যালাইনের চাহিদা রয়েছে। অথচ ওষুধ কোম্পানি থেকে তিন দিন পরপর সর্বোচ্চ ১০টি করে স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত ২০ সেপ্টেম্বর জরুরি ভিত্তিতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাড়তি দামে আরও ২০ লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতি ব্যাগের দাম ধরা হয়েছে ১৪৬ টাকা। এর আগে ১৮ ও ২০ সেপ্টেম্বর যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৫৩ হাজার ২৫০ ব্যাগ স্যালাইন আমদানি করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত এক ব্যাগ স্যালাইন (৫০০ মিলি) বিক্রি করা হতো ২৫ টাকায় এবং প্রতি ব্যাগ ১০০০ মিলি স্যালাইন ৪২ টাকায়। দৈনিক ১২ হাজার ব্যাগ উৎপাদন ক্ষমতার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্যালাইন ইউনিটটি বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী বিনা খরচে স্যালাইন ইউনিটটি চালু করতে চাইলেও সাড়া দিচ্ছে না মন্ত্রণালয়।