হাতছাড়া হচ্ছে প্রধান শ্রমবাজার!
বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক অভিবাসনের হার এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তবে হতাশার চিত্র মধ্যপ্রাচ্যে। শুধু সৌদি আরব ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে যে হারে বাংলাদেশিরা অভিবাসী হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি ফেরত এসেছেন। বিদেশি মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি অবদান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের। মোট অভিবাসীর প্রায় ৪৯ শতাংশই গেছে এ দেশটিতে। কিন্তু এত অভিবাসী গিয়েও প্রত্যাশিত প্রবাসী আয় আসছে না। প্রবাসী আয় কম হওয়ায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস) ২০২২-এ অভিবাসীদের এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএসের প্রকাশিত এ জরিপের তথ্য বলছে, আগের চেয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ওই বছর দেশ থেকে প্রতি হাজারে ৬ দশমিক ৬ জন মানুষ অভিবাসী হয়েছেন। ২০২১ সালে এই হার ছিল মাত্র ৩ জন।
সংস্থাটির প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০২২ সালে মোট অভিবাসীর ৪৮ দশমিক ৯৯ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশই গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ অভিবাসী গেছেন পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ায়, দেশটিতে গেছেন মোট অভিবাসীর ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে গেছেন ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
তবে ফেরত আসা অভিবাসীদের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবের। ২০২২ সালে দেশটি থেকে বাংলাদেশে অভিগমন হয়েছে ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ মানুষ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশি মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যে যত অভিবাসী গিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি ফেরত এসেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ অভিগমন বা ফেরত এসেছেন বাংলাদেশে। এ দেশগুলোতে গিয়েছিলেন মাত্র ১৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ অভিবাসী।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার হিসেবে পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। এ দেশেও যত অভিবাসী গিয়েছিলেন, ফেরত এসেছেন তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আলোচ্য সময়ে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ অভিবাসী, ফেরত এসেছিলেন ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ।
জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানিতে সংকটে পড়ার কারণ মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং নানাবিধ সামাজিক সমস্যা। পাশাপাশি তেলের দাম নিম্নমুখী হওয়া, কনস্ট্রাকশন খাতে চাকরির সুযোগ কমে যাওয়া, ভিসা ট্রেডিং এবং স্থানীয়দের কাজে সম্পৃক্ততার উদ্যোগ নেওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য সংকুচিত হয়ে আসছে। সরকারের পক্ষ থেকে নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও চলমান পরিস্থিতিতে ধারণা করা হচ্ছে সরকারের এ বছর ১২ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
জটিলতা কাটেনি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে। সেখানে চলছে ধরপাকড়। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স কমে আসায় সরকার নতুন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণে বৈশি^ক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জনশক্তি রপ্তানিতে শিগগিরই সুসংবাদ মিলছে না বলে মনে করছেন জনশক্তি রপ্তানি খাতের সংশ্লিষ্টরা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্র বলছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ১৫৮টির বেশি দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ ২৫ হাজার ৯৬৯ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বিদেশে। ১৫৮টি দেশে বাংলাদেশের কর্মী গেলেও দক্ষ জনবলের অভাবে বাংলাদেশের বাজার ৭ থেকে ৮টি দেশেই সীমাবদ্ধ।
জানা গেছে, বিএমইটির মহাপরিচালক পূর্বঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ গত বছরের ১২ নভেম্বর এক নোটিসে ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ কুয়েতের ভিসায় সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ মিশনের শ্রম সচিবের সত্যায়ন ছাড়া বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধ করে দেন। বহির্গমন ছাড়পত্র বন্ধ থাকায় বিদেশে গমনেচ্ছু কর্মীদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ কুয়েতের বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধ থাকায় বিদেশ গমনেচ্ছু শত শত কর্মী চরম বিপাকে পড়েছেন। বিএমইটির তথ্য অনুসারে, গত ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ইতালির বিভিন্ন কর্ম খাতে প্রায় ১৪ হাজার ৪৩৪ জন কর্মী চাকরি পেয়েছেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত কুয়েত থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রথম দেশে ফিরতে বাধ্য হন ১৯৯০ সালে ইরাকে আগ্রাসনের সময়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ফিরতে বাধ্য হয় ২০০৩ সালে ইরাকে আরেক দফা দখল ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর হামলার সময়। যুদ্ধবিধ্বস্ত কুয়েতে এরপর শ্রমবাজার অল্প বিস্তর সৃষ্টি হলেও নিষেধাজ্ঞা এসেছে দফায় দফায়। সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা আসে ২০০৭ সালে। এরপর দেশটিতে লোক যাওয়ার হার একেবারেই কমে যায়। তবে ২০১৪ সালের শেষ দিকে আবারও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। ২০১৭ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মী গেছেন দেশটিতে।