International

অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে

বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় উপায় হিসেবে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে কাজে লাগায়।

বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং কার্যকরের জন্য কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের আওতাধীন এ অফিসটি।

অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ব্যাপক ও সমন্বিতভাবে হতে পারে।

এছাড়া নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশের ওপরও হতে পারে। যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া তাদের সম্পত্তি জব্দ করা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র তার বৈদেশিক নীতি কিংবা জাতীয় নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ ধরণের পদক্ষেপ নেয়।

নিষেধাজ্ঞার ধরন
যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন সেটি দু’ধরণের হতে পারে।

একটি হচ্ছে- কোন দেশের সাথে আমদানি-রফতানি কিংবা লেনদেন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে– নির্দিষ্ট কিছু পণ্য বা সেবার আমদানি-রফতানি নিষিদ্ধ করা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমতি ছাড়া সেসব দেশের সাথে কোনো ব্যবসা করতে পারবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন ও বেসরকারি থিংক-ট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে জনাথন মাস্টার্স লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ব্যবহার করে।

এই নিষেধাজ্ঞা তারা দু’ভাবে আরোপ করতে পারে। একটি হচ্ছে- প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে, আরেকটি হচ্ছে- কংগ্রেসে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে।

১৯৫০ সালে চীন যখন কোরিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল গঠন করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আওতায় থাকা চীন ও উত্তর কোরিয়ার সব সম্পত্তি আটকে দেয়।

বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার ওপর নানা কারণে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকা, মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করা।

ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, ২০টির বেশি দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরণের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

এসব দেশের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, কিউবা, বেলারুশ, রাশিয়া, জিম্বাবুয়ে, সিরিয়া।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফরেন পলিসির এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে প্রথম বছরেই ৭৬৫টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিশ্বজুড়ে।

এর মধ্যে ১৭৩টি নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতাসীন হওয়ার আগ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে নয় হাজার ব্যক্তি, কোম্পানি, বিভিন্ন সেক্টর এবং কিছু দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

যেসব পন্থা ব্যবহার হয়
একটি দেশের ওপরে যখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় তখন সেটিকে ‘কান্ট্রি-বেইজড’ বা ‘দেশ-ভিত্তিক’ নিষেধাজ্ঞা বলা হয়।

এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে সব ধরণের বাণিজ্য ও লেনদেন নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার লিস্ট-বেইজড নিষেধাজ্ঞার পন্থা অবলম্বন করেছে।

এটি ‘স্মার্ট নিষেধাজ্ঞা’ হিসেবে পরিচিত। এর আওতায় পুরো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল-এর অ্যাটর্নি অফিস বলছে, ‘স্মার্ট নিষেধাজ্ঞার’ মাধ্যমে টার্গেট করা ব্যক্তিদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।

এতে দেশের সব জনসংখ্যার ওপরে প্রভাব পড়ে না। এছাড়া নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে সেটি বাস্তবায়ন করা সহজ হয়।

বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কয়েকটি বিষয় থাকতে পারে :

১. যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করা হবে সেগুলোর শুল্ক বাড়িয়ে দেয়া। এতে করে সেই দেশের পণ্যের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বৃদ্ধি পাবে। ফলে আমদানিকারকরা সেসব পণ্য আনতে নিরুৎসাহিত হবে এবং অন্যদেশ থেকে পণ্য আমদানির বাজার খুঁজবে।

২. যেসব দেশ কিংবা সেক্টরের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে সেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির ওপর একটি সীমা আরোপ করতে পারে। অর্থাৎ পুরোপুরি ব্যবসা বন্ধ না করে সেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে।

৩. যেসব দেশ, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় তাদের সম্পত্তি জব্দ করা হতে পারে।

এছাড়া বিভিন্ন ধরণের অশুল্ক বাধা তৈরি করে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞা
বিভিন্ন দেশের ওপর নানা কারণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

২০০৩ সালে জিম্বাবুয়ের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। জিম্বাবুয়ের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অবজ্ঞা করার অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল।

এর আওতায় যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল, তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তিও জব্দ করা করা হয়েছিল।

এদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি ছিলেন যাদের সাথে জিম্বাবুয়ে সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তবে জিম্বাবুয়ের পুরো সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি।

এছাড়া রাষ্ট্র হিসেবে জিম্বাবুয়ের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি।

ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কিউবার ওপর অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, যার মধ্যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা অন্যতম।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৩ সালে কিউবার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এর আওতায় কিউবা থেকে সব ধরণের আমদানি রফতানি নিষিদ্ধ করা হয়।

এরপর ২০০০ সালে সে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করে কিউবাতে চিকিৎসা সামগ্রী ও কৃষিজ পণ্য রফতানির অনুমতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

কিউবার সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করতে না পারে সেজন্য ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

এই নিষেধাজ্ঞা দেবার সময় যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, কিউবার সামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো দেশটির সাধারণ মানুষের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভর করে সুবিধা নিচ্ছে।

ল্যাটিন আমেরিকার আরেকটি দেশ ভেনিজুয়েলার ওপর আমেরিকার নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরই মধ্যে কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে দেশটির সরকারকে দুর্বল করার জন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোলের ওয়েবসইটে বলা হয়েছে, ভেনিজুয়েলার অবৈধ সরকারের রাজস্ব আহরণ সীমিত করা এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য এসব নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

এছাড়া ভেনিজুয়েলার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার বিপক্ষে যারা কাজ করেছে তাদের ওপরও এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

ইরানের ওপর ১৯৭৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, ইরানের শাসক গোষ্ঠীর রাশ টেনে ধরার জন্য এসব নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করা তাদের উদ্দেশ্য নয়।

নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দশকের পর দশক নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকার কারণে ইরান পরিস্থিতির সাথে অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

উত্তর কোরিয়ার ওপর আমেরিকার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর ফলে উত্তর কোরিয়ার সাথে আমদানি-রফতানি ও বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়।

নিষেধাজ্ঞা কতটা কাজে লাগে?
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা কতটা ফল দেয় সেটি নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর গ্লোবাল ফোরকাস্টিং ডিরেক্টর আগাথি ডেমারাইস চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে এনপিআরকে বলেন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা হয় দ্রুত কাজ করে, নয়তো কখনোই কাজ করে না।

‘যাদের টার্গেট করে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, সেসব দেশের অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞা একটি বড় ধাক্কা দেয়। যদি ছোট অর্থনীতির দেশ হয় তাহলে দু’টি বিষয় হতে পারে।

তারা হয়তো দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের মতবিরোধ কমিয়ে আনতে পারে, নয়তো নিষেধাজ্ঞার নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে,’ বলেন ডেমারাইস।

তাছাড়া অনেক দেশ আছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যেসব দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি সেসব দেশে নিষেধাজ্ঞা বেশি কার্যকর হয়।

যেসব দেশের সাথে আমেরিকার তেমন কোনো অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই সেসব দেশে নিষেধাজ্ঞা খুব একটা কার্যকর হয় না বলে মনে করেন ডেমারাইস।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto