Bangladesh

অবরোধে বড় ক্ষতির মুখে পর্যটন ব্যবসা

রকৃতিতে শীতের পদধ্বনি। এ সময়ে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার পর্যটকে ঠাসা থাকার কথা। অথচ সাগরতটে নেই হৈ-হুল্লোড়। বিশাল সৈকতে পর্যটকের পা না পড়ায় চারদিকে নির্জনতা। সারি সারি কিটকট (ছাতাসহ বসার চেয়ার) ফাঁকা। সমুদ্রপাড়ের নানা আনন্দ আয়োজনেও ভাটা। রকমারি পসরা সাজিয়ে সৈকত ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত দোকানির কাটছে অলস সময়। খালি হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতায় যেন লাটে উঠছে পর্যটন ব্যবসা।

শুধু কক্সবাজার নয়; হরতাল-অবরোধের কারণে গত এক সপ্তাহে সেন্টমার্টিন, রাঙামাটি, বান্দরবান, কুয়াকাটা, সিলেটসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান এখন পর্যটকশূন্য। এতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যটন-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের দাবি, গত এক সপ্তাহে শুধু কক্সবাজারেই ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। আর সারাদেশে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। 
নভেম্বর থেকে মার্চ– এ সময়টা পর্যটনের ভরা মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। উদ্যোক্তারা সারাবছর এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন। আর মৌসুমের শুরুতেই চলছে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা টানা অবরোধ। জ্বালাও-পোড়াও আর নাশকতার ভয়ে অগ্রিম বুকিং করে রাখা হোটেল-মোটেলের কক্ষ বাতিল করেছেন পর্যটক। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বিদেশি পর্যটকও বাংলাদেশ ভ্রমণ বাতিল করছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে। জানুয়ারি পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে এবারের পর্যটন মৌসুমে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হতে পারে বলে শঙ্কা ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব)।

কক্সবাজার শহর ও আশপাশের পর্যটন এলাকায় পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রেস্টহাউস ও রিসোর্ট রয়েছে। এতে অন্তত এক লাখ ৭০ হাজার পর্যটক থাকার সুবিধা রয়েছে। গত শুক্র ও শনিবার ৯৫ শতাংশ হোটেল-মোটেল ও গেস্টহাউসের কক্ষ খালি ছিল। অথচ বর্ষা মৌসুমেও এর চেয়ে বেশি পর্যটক কক্সবাজার এসেছেন বলে জানান পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, কক্সবাজারের পর্যটনের সব খাতে প্রতিদিনই ১০০ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে। হরতাল ও অবরোধ এভাবে চলতে থাকলে আমরা ব্যবসায়ীরা একদম শেষ হয়ে যাব।

শুধু সমুদ্রসৈকত নয়, পর্যটকের খরার এ ছবি প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন, ইনানীর পাথুরে সৈকত, হিমছড়ি ঝরনা, শহরের বার্মিজ মার্কেট, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, রামু বৌদ্ধবিহার, ডুলাহাজারার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কসহ কক্সবাজারের সবকটি বিনোদন কেন্দ্রে।

বান্দরবানে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তাজিংডং বিজয়, কেওক্রাডং, বগা লেক, নীলগিরি, রিজুক ঝরনা, চিম্বুক, নীলাচল, মেঘলা, স্বর্ণজাদি মন্দির, ন্যাচারাল পার্ক, শৈল প্রপাতসহ অনেক স্পট। তবে অবরোধের কারণে পর্যটক নেই সেখানে।

প্রতিবছর রাসমেলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সুন্দরবনের পর্যটন মৌসুম। দুবলারচরে রাস উৎসবে যোগ দিতে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরসহ ট্রলার ও নৌকার মালিকরা প্রচার-প্রচারণা চালালেও অবরোধের কারণে এ বছর দেশি-বিদেশি পর্যটকের সাড়া মেলেনি; বরং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার বেশির ভাগ ট্যুর অপারেটরের বুকিং এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে বলে জানান ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আযম ডেভিড। সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর জানান, হরতাল-অবরোধের আগে প্রতিদিন এ কেন্দ্রে ৩০০ থেকে ৫০০ পর্যটক আসত। এখন মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন পর্যটক আসছে। 

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে গত বছরের এমন দিনে পর্যটকের এতই চাপ ছিল যে ভ্রমণের জন্য ইঞ্জিনচালিত বোট পাওয়া যেত না। অথচ এখন কোথাও কোনো পর্যটক নেই। নৌকা নিয়ে সারাদিন ঘাটে বসে থেকেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে নৌযানচালকদের।

সিলেটের জাফলং, শ্রীপুর, জৈন্তা রাজবাড়ী, লালাখাল, শাহজালাল ও শাহপরাণের মাজার; সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এবং মৌলভীবাজারের দৃষ্টিনন্দন চা-বাগান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ও হাকালুকি হাওরে এ সময়টায় পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে। গত এক সপ্তাহে ১ শতাংশ পর্যটকও আসেনি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত কুয়াকাটায় এখন কলাপাড়া কিংবা পার্শ্ববর্তী এলাকার হাতেগোনা কিছু লোকজন ছাড়া দূরের কোনো পর্যটক নেই। সৈকত ও এর আশপাশের আকর্ষণীয় স্পটগুলো নির্জন পড়ে আছে।

টোয়াবের তথ্য বলছে, দেশে পর্যটনের এক হাজার ৬৮টি গন্তব্য আছে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনশিল্পের মোট অবদান ছিল ৭ হাজার ৮৩৩ মিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ২ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছর দেশে বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছে প্রায় ৫ দশমিক ২২ লাখ। সরাসরি ৫০ লাখ মানুষ পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত। জিডিপিতে যেন পর্যটন খাত ১০ শতাংশ অবদান রাখতে পারে, সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। তবে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় শেষ পর্যন্ত এর কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

পর্যটন-সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, হরতাল-অবরোধে গাড়ি পুড়লে সরকারি দলের নেতাকর্মী গাড়ির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ সময়ে পর্যটন খাতে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, তাদের দেখবে কে?
টোয়াব সভাপতি মো. শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, ভ্রমণ মানুষের বিনোদনের অংশ; মৌলিক চাহিদা নয়। টাকা দিয়ে তো আর কেউ মৃত্যু কেনে না। পর্যটন খাতকে হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১৩ সালের টানা রাজনৈতিক সহিংসতার পর পর্যটন খাত ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগেই আবার ২০১৫ সাল থেকে অবরোধ শুরু হয়। এরপর করোনার থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয় পর্যটন খাত। ঘুরে দাঁড়ানোর এ সময়ে আবারও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়েছে। 

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. রাহাত আনোয়ার বলেন, আমরা এ খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীসহ সবাইকে নিয়ে বৈঠক করব। দেশেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা অনুরোধ করছি, তারা যেন দেশের স্বার্থে পর্যটন খাতকে অবরোধের বাইরে রাখেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button