অর্থনীতিরও আশা সুষ্ঠু নির্বাচন
দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন ইস্যুতে এরই মধ্যে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ধারাবাহিকভাবে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। এ ছাড়া সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর জোরালো চাপ রয়েছে। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি। যে কারণে অর্থনীতি পড়তে যাচ্ছে আরেক বিপদে।
সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি বাঁচাতে একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
দেরিতে হলেও বিষয়টি সামনে এনেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। গত সোমবার সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল এক অনুষ্ঠানে ভোট আয়োজনের নানা পদক্ষেপের মধ্যে বিদেশিদের ‘হস্তক্ষেপ ও তৎপরতা’ দুঃখজনক বাস্তবতা বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের নির্বাচনে কিন্তু বাইরে থেকে থাবা, হাত এসে পড়েছে। তারা থাবা বিস্তার করে রেখেছে। আমাদের অর্থনীতি, আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে অর্থাৎ আমাকে বাঁচাতে হলে, জনগণকে বাঁচাতে হলে, তৈরি পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে হলে এ নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার ও ক্রেডিবল করতে হবে। দেশের জনগণের পাশাপাশি বাইরের ওরা কিন্তু খুব বেশি দাবি করেনি। একটাই দাবি, আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার ও ক্রেডিবল হওয়া লাগবে। এখানে কোনো রকম কারচুপির আশ্রয় নেওয়া যাবে না।’
করোনার অভিঘাত কাটিয়ে উঠলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। নতুন করে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে তার প্রভাবও পড়বে।
বর্তমানে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে ডলার। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় মিলিয়ে এখন যে পরিমাণের বিদেশি মুদ্রা আয় হয়, তা দিয়ে আমদানি ও ঋণ পরিশোধ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৬ বিলিয়নের নিচে নেমে যাওয়ায় দেশের জন্য সামনের দিনগুলোতে আরও বড় সংকট অপেক্ষা করছে বলে সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশের জন্য এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচন কেন্দ্র বিশে^র প্রভাবশালী দেশগুলোর হস্তক্ষেপ। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র চাইছে নির্বাচনী পরিবেশ ও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থের কথা বলে ইতিমধ্যেই সীমিত পরিসরে ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর ইউরোপের বাজারে ‘জিএসপি প্লাস’ পেতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও পরিবেশগত বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে ইইউ।
বাংলাদেশের রপ্তানি পশ্চিমা দেশকেন্দ্রিক। আর আমদানির বেশিরভাগই হয় ভারত ও চীন থেকে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর ২৭ দেশে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির অন্তত ৬০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা মোট রপ্তানির ৪৫ শতাংশ। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর বাইরে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণের রপ্তানি হয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের সবচেয়ে বড় উৎসও এসব দেশ। পশ্চিমা এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। ২০২২ সালে ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ২ হাজার কোটি ডলারের বেশি। একই সময়ে ৮১২ কোটি ডলার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন তো এমনিতেই প্রয়োজন দেশের স্থিতিশীলতার জন্য। সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার মতো বাণিজ্যিক বা আন্তর্জাতিক কোনো পদক্ষেপ যদি যুক্ত হয়, যেটা অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে ক্ষেত্রে এখানে বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বহির্বিশ্ব এ নির্বাচন কীভাবে নিল সেটা। বহির্বিশ্ব বলতে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের রপ্তানি বাজার, অর্থাৎ ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডা কী ধরনের অবস্থান নিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করবে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ।’
বিদেশিদের বাণিজ্যিক পদক্ষেপের লক্ষ্য ব্যক্তি না হয়ে প্রতিষ্ঠান বা দেশের রপ্তানিকেন্দ্রিক হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে বলে তিনি মনে করেন।
অবশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘বিএনপিসহ কিছু দল ছাড়া আর সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। পোশাক খাতে শ্রমের অধিকার নিয়ে যে বিষয়টি এসেছে, তা সঠিক নয়। শ্রম অধিকার খর্ব হওয়ার মতো কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি এবং ঘটবেও না। সুতরাং এ বিষয় নিয়ে কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সুযোগ নেই বা এমন পরিস্থিতি হবে বলে মনে হয় না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয় নিয়ে চিন্তিত নই। তবে বিষয়টি যদি রাজনীতিকরণ করা হয় তাহলে সেটি ভিন্ন জিনিস। যদি সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে যেকোনো কিছুই হতে পারে।’
বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থা সমর্থন দিচ্ছে চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলো, যাদের ওপর বাংলাদেশ নির্ভরশীল জরুরি খাদ্যপণ্য, শিল্প কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানিতে। মূলত চীন, ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানি করে প্রস্তুত পণ্য পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। দেশে যত আমদানি হয় তার প্রায় ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। আর মোট আমদানির ১৮ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি কিছুটা কমে ১ হাজার ৬৩ ডলার হয়েছে। বিপরীতে ভারতে রপ্তানি হয়েছে ১৮৬ কোটি ডলারের পণ্য।
বিনিয়োগ ও ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা বেশি পশ্চিমা দেশ ও সংস্থাগুলোর ওপর। বাংলাদেশের জন্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইর প্রধান উৎস এখনো যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ২ হাজার ২৪ কোটি ডলার, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫০ কোটি ডলার। ২০২২ সালে বাংলাদেশে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে ৬৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছে, যা মোট বিনিয়োগের প্রায় ১৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও (আইএমএফ) বাংলাদেশের বড় ঋণদাতা। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), যা পশ্চিমাদের মিত্র জাপান প্রভাবিত। এর বাইরে বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাও (জাইকা) বিপুল পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে।
বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ তুলনামূলক কম। মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ করেছে চীনারা। তিনটি এলওসির মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার চুক্তি করেছে ভারতের সঙ্গে। তবে এখন পর্যন্ত ১৪৯ কোটি ডলার ছাড় করেছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক।
সম্প্রতি জ¦ালানি তেলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে কঠিন শর্তে ও উচ্চ সুদে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ। এতে করে ঋণের বোঝা আরও বাড়বে।
চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণপ্রাপ্তিও উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সরকার যে পরিমাণের বিদেশি ঋণ পাচ্ছে, তার বেশিরভাগই সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। আগামীতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সরকার বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে ঋণ পেয়েছে ১৬২ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ কম। একই সময়ে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১১০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫২ শতাংশ বেশি। এখন সরকার যে ঋণ পাচ্ছে তার প্রায় ৬৮ শতাংশই চলে যাচ্ছে সুদ ও আসল পরিশোধে। গত অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে সরকারের ঋণ ৭৯ বিলিয়ন ডলার। বাকি ২১ বিলিয়ন বেসরকারি খাতের। মোট বিদেশি ঋণের প্রায় ১৬ বিলিয়ন স্বল্পমেয়াদি। ডলার সংকটের অন্যতম কারণও এটা।
বিদেশের ঋণ কমে যাওয়ায় সরকার অভ্যন্তরীণের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যাংক, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন উৎস থেকে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ রয়েছে ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। ওই সময় পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মিলিয়ে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রায় পাঁচ মাসে সরকারের ঋণ আরও বেড়েছে। পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় না থাকায় সরকারকে ধার করে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণও ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকায়। এর বাইরে আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও অবলোপন মিলিয়ে আরও প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা আটকে আছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে টাকার প্রবাহ কমিয়ে আনায় সুদহারও ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে। এতে ব্যবসা আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। ডলারের অব্যাহত দরবৃদ্ধিতে এমনিতেই দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নাকাল অবস্থায় রয়েছে। পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। সরকারও অর্থ সংকটের কারণে উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমবে।