Bangladesh

অস্তিত্বহীন এক কালভার্টে দফায় দফায় বরাদ্দ * লুট হয়েছে মসজিদ সংস্কারের টাকাও, বাবুগঞ্জে উন্নয়ন প্রকল্পের কোটি টাকা লোপাট

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের লাফাদি গ্রামের আকন বাড়ির সামনের একটি কালভার্ট নির্মাণে ১১ জুন দেড় লাখ টাকা দেয় উপজেলা প্রশাসন। উন্নয়ন সহায়তা খাতে বিশেষ বরাদ্দের আওতায় দেওয়া হয় ওই টাকা। এর ঠিক দুদিন পর একই কালভার্ট নির্মাণে আরও ১ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫২ টাকা দেওয়া হয় গ্রামীণ জনকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ খাত থেকে।

অথচ সরেজমিন সেখানে পাওয়া যায়নি কোনো কালভার্ট। যেখানে কালভার্ট নির্মাণ দেখানো হয়েছে সেখানে বহু বছর আগে থেকেই রয়েছে কংক্রিটের ব্রিজ। এখানেই শেষ নয়, অস্তিত্বহীন এ কালভার্ট সংলগ্ন ঈদগা মাঠ সংস্কারে দেওয়া আরও ৫০ হাজার টাকাও লোপাট হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, ঈদগা মাঠ সংস্কারে যে টাকা এসেছে, তা তারা জানেন না। আর কালভার্টও নির্মাণ হয়নি।

কেবল এই দুটি নয়, উন্নয়ন বরাদ্দের প্রায় সব প্রকল্পেই এভাবে হরিলুট হয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্মভূমি বাবুগঞ্জ উপজেলায়। তার নামে যে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন, সেটিও বাদ পড়েনি এই দুর্নীতির হাত থেকে। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ (পিআইও) কেউই অবশ্য স্বীকার করেননি এসব দুর্নীতির অভিযোগ। শতকরা একশ ভাগ কাজ হয়েছে দাবি তাদের। তবে সরেজমিন পরিদর্শন ও এলাকাবাসীর বক্তব্যে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। এমন একটি প্রকল্প পাওয়া যায়নি যেখানে পরিপূর্ণ কাজ হয়েছে। বরং বেশি মিলেছে কাজ না করে টাকা তুলে নেওয়া প্রকল্পের সংখ্যা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে ক্ষোভ।

কখন বরাদ্দ আসে, কখন কাজ হয় আর কখন লোপাট হয় টাকা তা টের পায় না কেউ।

২০২২-২৩ অর্থবছরে অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৬ কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ পেয়েছে বাবুগঞ্জ উপজেলা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ খাতে এসেছে এসব বরাদ্দ। স্থানীয় সংসদ-সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি লুৎফুন্নেসা খানের নামে আসা প্রায় ৩ কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ রয়েছে এই হিসাবে। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ দিয়ে উপজেলার ৬ ইউনিয়নে একশর বেশি উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় প্রশাসনের। তবে বাস্তবে এর অধিকাংশেরই কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। কাজ না করেই কয়েক কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। ফাইলে জমা হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের মিথ্যা দলিল। সরেজমিন পরিদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারাও জানিয়েছেন একই অভিযোগ।

দৈবচয়ন ভিত্তিতে বাছাই করে উপজেলার গোটা পনেরো উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনকালে ধরা পড়ে এসব দুর্নীতি। এমনই একটি প্রকল্প দেহেরগতি আইএন উচ্চ বিদ্যালয় ভবন সংস্কার। একই অর্থবছরে ভিন্ন দুটি খাত থেকে এই প্রকল্পে মোট ২ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫২ টাকা ব্যয়ের হিসাব জমা আছে উপজেলা প্রশাসনে। অথচ সংস্কারের কোনো চিহ্ন মেলেনি সেখানে। বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মীরন বলেন, ‘আপনার মুখ থেকেই প্রথম শুনলাম বরাদ্দের কথা। সংস্কার দূরে থাক, এক চাকা মাটিও তো কেউ ফেলেনি এখানে।’ বিদ্যালয় সংলগ্ন জামে মসজিদ সংস্কারের নামেও লোপাট হয়েছে অর্থ। মসজিদ সংস্কারের নামে একই অর্থবছরে দুই দফায় ভিন্ন দুই খাতে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫২ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ সম্পর্কে মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ আ. রহিম হাওলাদার বলেন, ‘এখানে কোনো সংস্কার কিংবা উন্নয়ন হয়নি। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী ইমদাদুল হক দুলাল মসজিদ ফান্ডে ১ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন।’

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে উপজেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, লুটপাটের অংশ হিসাবে একই প্রকল্পে একাধিকবার বরাদ্দ নেওয়ার ঘটনাও হরহামেশা ঘটেছে এখানে। চলতি অর্থবছরেও মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন খাত দেখিয়ে একই প্রকল্পে দুবার করে দেওয়া হয়েছে বরাদ্দ। এরকম একটি প্রকল্প দেহেরগতি ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডে মো. ফিরোজ হাওলাদারের বাড়ির সামনের রাস্তা সংস্কার। দুদিনের ব্যবধানে এই প্রকল্পে নেওয়া হয় মোট ২ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫২ টাকা। অথচ বাস্তবে মাত্র ২৫ হাজার টাকার কাজ হয়েছে সেখানে। যার বাড়ির সামনে কাজ সেই ফিরোজ হাওলাদার বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ভ্যাট ট্যাক্স কেটে ২৫ হাজার হাতে পেয়েছি। তাই দিয়ে ১৫০ ফুট রাস্তা সংস্কার করেছি। শুনেছিলাম যে ১ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কার হবে। এর বাইরে আমি কিছুই জানি না।’ এরকম আরও অন্তত ৩০ প্রকল্পের সন্ধান মিলেছে যেগুলোতে অবৈধভাবে ডাবল বরাদ্দ নিয়ে লোপাট করা হয়েছে টাকা।

আরো যেসব প্রকল্পে এভাবে কাজ না করে কিংবা সামান্য করে টাকা হাতানোর প্রমাণ মিলেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-পাংশা গ্রামে কাজী ইমরান হোসেন সাবুর বাড়ি থেকে মল্লিক বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার, মোসলেম আলী খান মডেল মাদ্রাসা মাঠে বালু ভরাট, একই মাদ্রাসার ভবন সংস্কার, মেঘিয়া ফিরোজ মোল্লার বাড়ির সামনে কালভার্ট নির্মাণ, দেহেরগতি শামসুল জ্যা দলিলের বাড়ির সামনের রাস্তা সংস্কার, বাহেরচর ক্ষুদ্রকাঠি লতিফ হাওলাদারের বাড়ি থেকে সোবাহান আকনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে মাটি ভরাট, জসিম মৃধার বাড়ির সামনের রাস্তা সংস্কার এবং পশ্চিম পাংশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে আ. রব মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার। সরেজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব প্রকল্পে তেমন কোনো কাজ হওয়ার নজির মেলেনি। অথচ এসবের বিপরীতে বরাদ্দ হওয়া টাকা ঠিকই তুলে নেওয়া হয়েছে কাজ সম্পন্নের ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে।

আলাপকালে বাবুগঞ্জের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরই আমরা বিল দিয়েছি। এক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনও করা হয়েছে। কাজ না করে কেউ টাকা নিতে পারেনি।’

উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী ইমদাদুল হক দুলাল বলেন, ‘এডিপির আওতায় যেসব কাজ হয়েছে তার বিল এখনো পরিশোধ করা হয়নি। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। তারা কাজ করার পর পিআইও অফিসের পরিদর্শন ও উপজেলা প্রশাসনের অনুমোদন সাপেক্ষে বিল প্রদান করা হয়। এখানে অনিয়ম হওয়ার সুযোগ কম। তারপরও আমি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখব। কোনো অনিয়ম হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d