‘আরেকটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের জন্যই এ আয়োজন’
‘আইনটি পাস হলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে। জনসাধারণকে নির্বিচার আটক ও হয়রানির ঘটনা বাড়বে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধীকে আটক করার বিধান রেখে যে ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল’ জাতীয় সংসদে তোলা হয়েছে, তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পুলিশের একজন সাবেক মহাপরিদর্শক, আইনজীবী ও বিশিষ্টজনরা।
এটিকে একটি ‘নিপীড়নমূল ও জনস্বার্থবিরোধী’ আইন হিসেবে অভিহিত করে তারা বলেছেন, আইনটি পাস হলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে। জনসাধারণকে নির্বিচার আটক ও হয়রানির ঘটনা বাড়বে। একই ক্ষমতা দুটি বাহিনীকে দেওয়ার কারণে তাদের মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।
এক্ষেত্রে সাবেক মহাপরিদর্শক বাদে অন্যদের ভাষ্য, ২০১৮ সালের মতো আরেকটি ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচন করার উদ্দেশ্যেই তড়িঘড়ি করে আইনটি পাস করতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার।
গত সোমবার জাতীয় সংসদে বিলটি উত্থাপন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রস্তাবিত বিলের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যাটালিয়ন সদস্যের সামনে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধীকে আটক করে অবিলম্বে পুলিশের কাছে সোপর্দ করবে এবং ক্ষেত্রমতো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি; কোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি এবং মালামাল জব্দ করতে পারবে।’
যদিও আজ বুধবার সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আনসার বাহিনীকে গ্রেপ্তারের অনুমতি কখনোই দেওয়া হয়নি এবং আজকেও দেওয়া হবে না। বিলটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। এখানে কোনো শব্দ, কোনো বাক্য যদি এই ধরনের প্রশ্নের অবতারণা করে, তাহলে সেগুলোর সংশোধন হবে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এবং সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের সঙ্গে।
এ ব্যাপারে আইনজীবী শাহদীন মালিকের ভাষ্য, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুসারে আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষমতা একমাত্র পুলিশের। এখন সরকার একই ক্ষমতা দিয়ে আরেকটি বাহিনী তৈরি করতে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, ‘ঠিক নির্বাচনের আগে এটা করার উদ্দেশ্য হলো নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের হাতে আনসার ব্যাটালিয়নের আরও কম-বেশি ২০ হাজার রেডিমেড ফোর্স চলে আসবে। এতে স্পষ্টই মনে হচ্ছে যে সরকার ওই ২০১৮’র মডেলের নির্বাচন করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে পুলিশ বাহিনী এ ব্যাপারে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। এ আপত্তিটা নিশ্চয় গভীর। কারণ পুলিশ বাহিনীর বহু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। পুলিশ এতে অখুশি হলে সরকারের যে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন সেই উদ্দেশ্যটা ব্যহত হয় কি না, তার একটা শঙ্কা তো থেকেই যায়।’
শাহদীন মালিকের ধারণা, ‘এখন আইন করে ক্ষমতাটা আনসারকে দিয়ে রাখবে সরকার। কিন্তু এর প্রয়োগ হবে নির্বাচনের আরও কাছে গিয়ে।’
বিষয়টি নিয়ে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা বিগত নির্বাচনটা যেরকম দেখেছি তাতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের জন্য জনগণের ওপর ভরসা না রেখে অনেক বেশি বাহিনীগুলোর ওপর ভরসা রেখেছে।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এই বাহিনীগুলোকে শক্তিশালী করা হচ্ছে কেন? নিরাপত্তার নামে তো। নিরাপত্তা তো বাহিনীগুলো যতটা না দিতে পারে তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক দলগুলো দিতে পারে বলে আমাদের ধারণা। কারণ তারা যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা কোনো সংঘর্ষ করবে না, তাদের দলীয় সমর্থক, কর্মীদের যদি কড়া নির্দেশ দেয় যে আমরা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, তোমরা কোনো ধরনের সংঘর্ষ করবে না, অনিয়ম-উশৃঙ্খলতা করবে না, তাহলে কিন্তু এত সহিংসতার আশঙ্কা থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখেছি ক্ষমতাসীন দল অনেক বেশি আমলা এবং এ সমস্ত বাহিনীগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে ক্ষমতায় থাকার জন্য। নির্বাচনের কারণে আরও বেশি করেই সেটা দেখা গেছে।’
সুলতানা কামালের অভিমত, ‘একটা গণতান্ত্রিক সরকার এত সহজে যেকোনো বাহিনীকে একজন নাগরিককে আটক করার ক্ষমতা দিয়ে দিতে পারে না। নাগরিককে আটক করা কী এতই সহজ? কাউকে আটক করার ক্ষেত্রে খুবই সুনির্দিষ্ট কারণ ও যথাযথ বিধিমালা থাকতে হবে। এই ক্ষমতা সরকার যে কারুর হাতে দিয়ে দিতে পারে না। এটা জনগণের সঙ্গে খুবই অগণতান্ত্রিক একটা আচরণ। নিপীড়নমূলক আচরণ।
‘এভাবে চললে তো একসময় বলা হবে গ্রাম প্রতিরক্ষা দলও এটা (আটক-তল্লাশি) করতে পারবে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করতে পারবে। স্বেচ্ছাসেবক লীগও করতে পারবে, ছাত্রলীগও এটা করতে পারবে। যুবলীগও এটা করতে পারবে।’
তার ভাষ্য, এর আগে যতগুলো বাহিনীকে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে আটক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার সবগুলো উদ্যোগই অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘কাউকে গ্রেপ্তারের জন্য একটা বিচারিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এখানে বিচারিক প্রক্রিয়াটা কোথায়? সেটা অনুপস্থিত। কাজেই এটা হতে পারে না। আমি এটা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমি আশা করি সরকার এটা পুনির্বিবেচনা করবে।’
একইসঙ্গে এই আইনটিকে একটি ‘কালাকানুন’ হিসেবেও অভিহিত করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা। বলেন, ‘এমন উদ্যোগে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি খুবই অসহায় বোধ করছি।’
এ ব্যাপারে সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের বক্তব্য, ‘এটা একটা অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি এটা সঠিক সিদ্ধান্ত না। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় দুইটা মূল কম্পোনেন্ট। একটা হলো পুলিশ, আরেকটি আদালত। পুলিশ ইনিশিয়েট করে। আদালতে তা শেষ হয়। কাজেই এর বাইরে আর কারুর আদালতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার সুযোগ নাই।
‘এখন পুলিশের প্যারালাল আরেকটি সংস্থাকে যদি আপনি গ্রেপ্তার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেন তাহলে তো তারা পুলিশের ক্ষমতাই পেয়ে গেল। পুলিশের ক্ষমতা যদি একাধিক সংস্থার হাতে থাকে তাহলে তো তাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি ও সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এটার তো প্রয়োজন নেই।’
সাবেক এই পুলিশপ্রধান আরও বলেন, ‘পুলিশের অনেকগুলো উইং আছে। মেট্রোপলিটন পুলিশ আছে, থানা পুলিশ আছে, সিআইডি আছে, পিবিআই আছে, র্যাব আছে। এরাই তো যথেষ্ট। কার স্বার্থে আনসারকে এই ক্ষমতা দিতে হবে? এখানে রাষ্ট্রের কী স্বার্থ থাকতে পারে? আইন তো আপনি করবেন রাষ্ট্রের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে। এই আইন জনগণের স্বার্থে হবে না। ক্যাওয়াজ সৃষ্টি হবে। দুটি বাহিনীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। সেটা তো হওয়া উচিত না। তাও নির্বাচনের আগে।
‘নির্বাচনের আগে আপনি আনসারকে খুশি করতে চান। তাতে পুলিশ অখুশি হবে। এই ধরনের পরিস্থিতি তো কাম্য হতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা দেশের দুইটা প্যারালাল পুলিশি সিস্টেম থাকতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো সমন্বয় করা। নতুন নতুন আইন করে বিতর্ক সৃষ্টি করা মন্ত্রণালয়ের কাজ না।’
আনসার এবং ভিডিপির মোট সদস্যসংখ্যা ৬১ লাখ। তবে এর মধ্যে কমপক্ষে ২০ হাজার ব্যাটালিয়ন আনসারের সদস্য। প্রস্তাবিত বিল অনুসারে এই ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন ব্যাটালিয়ন আনসারের সদস্যরা। আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের আনসার বাহিনী হচ্ছে একটি সাহায্যকারী বাহিনী এবং সব মিলে একে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অক্সিলারি ফোর্স বলা হয়ে থাকে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে শহীদুল হক বলেন, ‘আনসার যদি পুলিশের কাজই চায় তাহলে তাদের পুলিশের সঙ্গে মার্জ করে দিক। আলাদা বাহিনীর কী দরকার।’