Bangladesh

ইউএনও পাচ্ছে গাড়ি, সরকারি চাকরিজীবীরা প্রণোদনা, উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য কী?

বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে উপবৃত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডলার, মূল্যস্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ- এসব জটিল বিষয় বোঝেন না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শ্রমজীবী অভিভাবকরা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের পাশে দাঁড়াবে কে?

জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নতুন গাড়ি দিতে চায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন শাখার গত ২৩ জুনের একটি পত্র থেকে জানা যায়, জেলা প্রশাসকদের জন্য মিতসুবিসি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স জিপ ৯৬টি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য একই মডেলের ৩৬৫টি জিপ চাওয়া হয়েছে। এজন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৬১২ কোটি টাকা। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরও চেয়েছে নতুন গাড়ি।

গাড়ি কেনার ব্যাপারে সরকার সবসময়ই দিলখোলা। দেশের বিভিন্ন খাতে সেবা প্রত্যাশীদের নানা সমস্যা থাকলেও গড়ি ক্রয় খাতে মোটামুটি একটা নীতি দাঁড়িয়ে গেছে বাংলাদেশে। সেটা হলো- পাজেরোর নিচে খুব একটা গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয় না। উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রদের গাড়ি দেখলে এটা সহজেই বোঝা যায়।  

গাড়ি কেনার নীতিতে যেহেতু আমরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছি, সেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ও চুপ থাকে কী করে! আর সেজন্যই সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আরও দামি গাড়ি কেনার সুযোগ করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। নিবন্ধন ও শুল্ক-করসহ গাড়ির দাম নির্ধারণ করে নতুন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে গত ১ আগস্ট। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এখন সর্বোচ্চ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি কেনা যাবে।’ আগে গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ৯৪ লাখ টাকা।

গাড়ি বিলাস বা প্রয়োজন যেটাই হোক, বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য মাঝেমধ্যেই সুখবর দেয় সরকার। এরকমই একটি সুখবরের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গত ১৮ জুলাই। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে চাকরিরত সরকারি কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম প্রণোদনা এক হাজার টাকা। অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মচারীরা পাবেন ন্যূনতম ৫০০ টাকা। জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত সরকারি, বেসামরিক, স্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও পুলিশ বাহিনীতে নিয়োজিত কর্মচারী এবং পেনশনভোগী ব্যক্তিদের ১ জুলাই থেকে ৫ শতাংশ হারে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হলো।’

সরকারি চাকরিজীবীদের আবাসনে এখন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আগে যেখানে সরকারি চাকরিজীবীদের আবাসন ছিল ৮ শতাংশ, সেখানে এখন ২৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বহুতল আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে গেল কয়েক বছরেই খরচ করা হয়েছে ৯৯০ কোটি ৩০ লাখ ১৯ হাজার টাকা।

দেশের অর্থনীতি যে শক্তিশালী অবস্থানে আছে এটা বার বার বলে আসছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। গাড়ি, বাড়ি বা বিশেষ প্রণোদনাসহ নানা প্রকল্প এর সমর্থনও করে। কিন্তু আজকের এই লেখার অবতারণা আরেকটি প্রকল্প নিয়ে। প্রকল্পের উপকারভোগীর সংখ্যা অনেক এবং এই উপকারভোগীরাই একসময় নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশের। এই প্রকল্প হলো- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন উপবৃত্তি প্রকল্প। 
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, ভর্তির হার বৃদ্ধি, মেয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করা হয়। ২০০৩ সাল থেকে চালু হয় দেশব্যাপী। শিক্ষার্থীর মায়ের হাতে বছরে এক হাজার ২০০ টাকা পৌঁছার কারণে প্রকল্প চালুর পরের বছরই প্রাথমিকে ভর্তিতে সুফল মিলতে শুরু করে। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। কমতে থাকে অনুপস্থিতির হার। শুরুর বছর প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হতো মাসে ৫০ টাকা করে। আর প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ১০০ টাকা। এই সময়ের মধ্যে সরকারের নানা স্তরের চাকরিজীবীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও অবহেলিত ছিল উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা। তবে ২০২০ সালের শুরুর দিকে প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির পরিমাণ ২৫ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ টাকা, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীদের ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ১৫০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়। গত দুই দশকে উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে মাত্র একবার। অর্থাৎ, এই সময়ের মধ্যে কেউ ভাবেনি উপকারভোগী ১ কোটি ৪০ লাখ উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর কথা। একসময় মায়ের হাতে এই টাকা দেওয়া হলেও এখন দেওয়া হয় ডিজিটাল লেনদেন সার্ভিস ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। শিক্ষার্থীর অর্থ পৌঁছে যাচ্ছে মায়ের মোবাইলে। উন্নতি বলতে এটুকুই।

উপবৃত্তিরও আবার আছে নানা নিয়ম। যেমন- ২০২০ সালের শেষ দিকে ৬ মাস বন্ধ ছিল উপবৃত্তি দেওয়া। যুক্তি ছিল প্রকল্পের মেয়াদ শেষ দিকে বলে বিলম্ব। যদিও পরে ওই অর্থ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়। বছরে ৩ কিস্তিতে মেলে অর্থ। এক শিক্ষার্থীর পরিবারকে দেওয়া হয় ১৫০ টাকা। দুই শিক্ষার্থীকে ৩০০ টাকা। তবে একই পরিবারে ৩ শিক্ষার্থী হলে ৪০০ টাকা আর ৪ শিক্ষার্থীর পরিবারকে দেওয়া হয় মাসে ৫০০ টাকা। এসব নিয়ে অভিভাবকদের বলার কোনো জায়গা নেই। অথচ শিক্ষার্থী স্কুলে যায় বলে সামান্য কিছু অর্থ পাওয়া যায়- এই মনোভাবের কারণে শিশুশ্রমে দিতে নিরুৎসাহিত হতেন অভিভাবকরা। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তারা মনে করেন- প্রাথমিক শিক্ষার এতো অগ্রগতির নেপথ্যে ‘উপবৃত্তির’ একটা বড় ভূমিকা আছে।

নানা প্রকল্পের খরচ বছর বছর শুধুই বাড়ে, বাড়ে চাকরিজীবীদের সুযোগ-সুবিধাও। অথচ শিক্ষা উপকরণের দাম যেভাবে বাড়ছে সেই তুলনায় কি বেড়েছে উপবৃত্তির অর্থের পরিমাণ? উপবৃত্তি প্রকল্প যখন শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯৯ সালে, তখন ৩ টাকায় মিলতো নিউজপ্রিন্টের কাগজ। মলাট দেওয়া উন্নত মানের এ ফোর সাইজের খাতা পাওয়া যেত ১০ টাকায়। সময় গড়িয়েছে অনেক। এখন বাজারে নিম্নমানের কাগজের দিস্তাই ২০ টাকা। ৯০ টাকায় মেলে বাঁধাই করা ১০০ পাতার নিচের খাতা।  
 
খাতা আর কাগজই শুধু নয়, কলম, পেন্সিল, শার্পনার, রাবার, জ্যামিতি বক্স, স্কুল ড্রেস, ফাইল, জুতা, মোজাসহ নানা শিক্ষা উপকরণ কিনতে হিমশিম খেতে হয় অভিভাবকদের। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা যখন তাদের গাড়ির জন্য বরাদ্দ চান, তখন কি একবারও তাদের মনে হয় না এই ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীরা কথা, যারা আগামীর বাংলাদেশ?

বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে উপবৃত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডলার, মূল্যস্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ- এসব জটিল বিষয় বোঝেন না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শ্রমজীবী অভিভাবকরা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের পাশে দাঁড়াবে কে? বর্তমানে যে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে, সেই অর্থ দিয়ে শিক্ষা ব্যয় নির্বাহ করা একেবারেই অসম্ভব। উপবৃত্তির অর্থের পরিমাণ যদি সমন্বয় করা না হয়, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে প্রাথমিক শিক্ষায়। আর প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে পরবর্তী সব শিক্ষার দরজা। পরিস্থিতি বদলাতে নীতি-নির্ধারকদের এখনই উপবৃত্তির অর্থ বাড়ানোর বিষয়ে আওয়াজ তোলা প্রয়োজন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d