Bangladesh

উত্তরাঞ্চলে কৃষিতে অশনি সংকেত

রংপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে তামাক চাষ বাড়ছে সাতটি কোম্পানি কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক ও সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা দিয়ে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে লালমনিরহাট জেলায় ৭০ শতাংশ তামাক উৎপাদিত হয় তামাক চাষ বেড়ে যাওয়ায় গমের চাষ কমে গেছে

রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে আলু, ধান, পাট, ভুট্টা চাষ হয়ে থাকে। গত কয়েক বছরে ভুট্টা চাষে বিপ্লব ঘটেছে। অথচ বিগত শতকের সত্তুর, আশি, নব্বই দশকে ব্যাপকভাবে তামাকের চাষ হতো। পরবর্তীতে তামাক চাষে নিরুস্বাহিত করে কৃষকদের ভুট্টা ও আলু চাষে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে গত ত্রিশ বছরে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নিলফামারি, গাইবান্ধা জেলায় ব্যাপকভাবে আলু চাষ হয় এবং তামাক চাষ কমে যায়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিড়ি ও সিগারেট কোম্পানি তথা বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলো বৃহত্তর রংপুরের কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে অগ্রিম টাকা দেয়া এবং ভালো দাম দেয়ায় কৃষকদের মধ্যে ফের তামাক চাষে আগ্রহ বাড়ছে। এভাবে খাদ্যপণ্য চাষের বদলে কৃষকদের তামাক চাষে বেশি উৎসাহী হওয়া উত্তরাঞ্চলের কৃষির জন্য অশনি সংকেট বটে।
রংপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে তামাক চাষ প্রতিবছর বাড়ছে। চলতি বছর বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার ১৩ হাজার ৩৪৯ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এটা গত বছরের তুলনায় ২ হাজার ৫২৯ হেক্টর অর্থাৎ ১৯ হাজার বিঘা বেশি। তামাক চাষের এই হিসাব সরকারের কৃষি বিভাগের। তবে তামাকবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের দাবি, তামাক চাষে ব্যবহৃত প্রকৃত জমির পরিমাণ এর চেয়ে আরো অনেক বেশি।

জানতে চাইলে লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সৈয়দা সিফাত জাহান বলেন, তামাক চাষ খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে উঠেছে। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ ছাড়া তামাক চাষ কমানো যাচ্ছে না। কৃষি বিভাগ কেবল তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো কৃষকদের কাছে তুলে ধরে। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছে না। তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, তামাক গাছে প্রচুর শিকড় থাকে। জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। তামাক চাষের পর পরবর্তীতে ওই জমিতে অন্য ফসলের আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। তামাক চাষ মাটির জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর।

তামাক চাষ বেড়ে যাওয়ায় গম চাষ কমেছে। মূলত গমের জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। চলতি বছর রংপুর অঞ্চলে ৩ হাজার ১৮৩ হেক্টর জমিতে গম চাষ কমেছে। চলতি বছর রংপুর অঞ্চলে গমের চাষ হয়েছে ১৭ হাজার ১৬৭ হেক্টর জমিতে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৩৫০ হেক্টর। আর পাঁচ বছর আগে এ অঞ্চলে গম চাষ হয়েছিল ২৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে।

জানা গেছে, বিড়ি, সিগারেট ও তামাক ব্যবসার কোম্পানিগুলো কৃষকদের অগ্রিম টাকাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তামাক চাষে উৎসাহী করছে। তারা জমি চাষের সময় থেকে অগ্রিম টাকা কৃষকদের দিয়ে থাকেন। বেশি লাভের সুবিধা পেয়ে কৃষকেরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এতে পরিবেশদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার পাশাপাশি এ অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তামাক চাষে কার্যকর কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, তামাক চাষের বিরুদ্ধে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেও কৃষকদের তামাক চাষ থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না।
কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য অনুসারে, এ অঞ্চলে উৎপাদিত মোট তামাকের ৭০ শতাংশই উৎপাদিত হয় লালমনিরহাট জেলায়। এর পরের অবস্থান রংপুর ও নীলফামারীর। রংপুরের মমিনপুরের পাশাপাশি লালমনিরহাটের সারপুকুর, সাপ্টিবাড়ী, ভাদাই, দুর্গাপুর ও কাকিনা ইউনিয়নের পরিচিতি তামাকের ইউনিয়ন।
জানতে চাইলে তামাকবিরোধী জোট অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যের চেয়ে দ্বিগুণ জমিতে এবার তামাকের চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলে সাতটি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। মৌসুমে প্রতিটি কোম্পানির ৭০ লাখ থেকে এক কোটি কেজি তামাক কেনেন। কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক ও সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা দেয়া বন্ধ না করা গেলে তামাক চাষ কমানো যাবে না। পরিস্থিতি আগামীতে আরও ভয়াবহ হবে।

লালমনির হাট জেলার আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, তামাক চাষের আওতা বাড়ার কারণে খাদ্যশস্যের (ধান, গম, ভুট্টা, আলু) উৎপাদন যে কমে আসছে। বিধিনিষেধ না থাকায় তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের মুটুকপুর গ্রামের কৃষক ওসমান আলী গত বছর তিন বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছিলেন। এ বছর অধিক মুনাফার আশায় তিনি তামাক চাষের জন্য আরো দুই বিঘা জমি বাড়িয়েছেন। তিনি জানান, সাত-আট বছর আগেও তিনি তার আট বিঘা জমির পুরোটাই ব্যবহার করতেন ধান, সরিষা ও গমসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদনের কাজে। গত বছর তিন বিঘা জমি থেকে তিনি ২১ মন তামাক পেয়েছিলেন। উৎপাদিত তামাক বিক্রি করেছিলেন ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকায়। এতে তার খরচ হয়েছিল ৩৮ হাজার টাকা। তামাক কোম্পানিগুলো আরো বেশি মুনাফার আভাস দেয়া ওসমান আলী গত বছরের চেয়ে আরো দুই বিঘা জমিতে তামাক চাষ বাড়িয়েছেন। তিনি জানান, তামাক চাষে পরিশ্রম বেশি, লাভও বেশি। কোম্পানিগুলোই অগ্রিম টাকা দিয়ে তামাক কিনে নেয়। এছাড়া বিনামূল্যের বীজ, সার ও কীটনাশক দিয়ে থাকে। সুদমুক্ত ঋণ সুবিধাও পাওয়া যায়।

তামাক বিরোধী সংগঠনের নেতাদের আশঙ্কা এভাবে ধান, গম, আলু, ভুট্টার জমিতে তামাকের আবাদ বেড়ে গেলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। জমির উর্বরতাও হারিয়ে ফেলছে। কৃষকদের তামাক উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করতে ধান, গম, ভুট্টা ও আলু চাষে কৃষকদের সহায়তা করতে হবে; অন্যদিকে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা যাতে কৃষকদের লোভ দেখিয়ে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করতে না পারে সে লক্ষ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button