Bangladesh

উন্নত সংকেতব্যবস্থা নেই ৬৯ শতাংশ রেলস্টেশনে, বাংলাদেশ রেলওয়ে

২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর। ঘটনাস্থল নরসিংদী। চট্টগ্রাম থেকে আসছিল চট্টলা এক্সপ্রেস। বিপরীত দিক থেকে আসছিল মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেস।

মুখোমুখি সংঘর্ষে মহানগর ট্রেনের ওপর উঠে যায় চট্টলা। ওই দুর্ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়।

তদন্ত কমিটি জানায়, ভুল সংকেতের (সিগন্যাল) কারণেই ঘটেছিল ওই প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। চট্টলা এক্সপ্রেস মূল লাইন দিয়ে ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু ভুল সংকেতের কারণে ট্রেনটি লোকাল লাইনে ঢুকে যায়। ওই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল মহানগর গোধূলি।

রেলস্টেশন

গত ১৭ এপ্রিল কুমিল্লায় সোনার বাংলা এক্সপ্রেসকে একটি মালবাহী ট্রেন এসে ধাক্কা দেয়। ওই ঘটনায় কেউ মারা যায়নি। ভুল সংকেতের কারণেই মূল পথে না গিয়ে মালবাহী ট্রেনটি স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানোর সংরক্ষিত লাইনে ঢুকে পড়ে।

সর্বশেষ ভৈরবে গত সোমবার ঘটা দুর্ঘটনার জন্য ভুল সংকেতকে প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হচ্ছে। ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই দুর্ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রকাশিত রেলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ রেলওয়ের ৪৮৯টি স্টেশনের মধ্যে ৩৫৯টিতে সংকেত ব্যবস্থা আছে। আর ৩৫৯টি স্টেশনের মধ্যে উন্নত সংকেতব্যবস্থা আছে মাত্র ১১২টিতে। অর্থাৎ প্রায় ৬৯ শতাংশ রেলস্টেশনে উন্নত সংকেতব্যবস্থা নেই।

কয়েক রকম সংকেতব্যবস্থা

রেলের তথ্য অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলে ১৭০টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৮৯টি স্টেশন আছে। কিন্তু সব স্টেশনে সংকেতব্যবস্থা একই রকম নয়। এতেই এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়ে আছে। শুধু ২০২০ সালে রেলে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে তার ৬.২৫ শতাংশ ভুল সংকেত বা সংকেতের ত্রুটির কারণে ঘটেছে।

রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানান, সব স্টেশন আধুনিক সংকেতব্যবস্থার আওতায় আনার কাজ চলছে। বেশির ভাগ স্টেশনে সংকেত এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চালানো হয়। তাই সংকেতের ভুলও অনেক সময় মানুষের ভুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

রেলওয়ের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রেলের পূর্বাঞ্চলের ৮২টি স্টেশনে উন্নত সংকেতব্যবস্থা বা কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলকিং রয়েছে। আধুনিক সংকেতব্যবস্থায় এটাই থাকার কথা। এর বাইরে এই অঞ্চলে ২০টি স্টেশনে রেলওয়ে ইন্টারলকিং রয়েছে। ডাবল ওয়্যার মেকানিক্যাল ইন্টারলকিং রয়েছে ১১টি স্টেশনে। তিনটি স্টেশনে নন-ইন্টারলকড মেক্যানিকাল এবং ৫৪টি স্টেশনে নন-ইন্টারলকড কালার লাইট রয়েছে।

রেলের পশিমাঞ্চলে কম্পিউটার

বেইজড ইন্টারলকিং আছে ৩০টি স্টেশনে। রেলওয়ে ইন্টারলকিং আছে দুটি স্টেশনে। ডাবল ওয়্যার মেকানিক্যাল ইন্টারলকিং ২৩টি স্টেশনে। মেকানিক্যাল ইন্টারলকিং (প্রত্যক্ষ) ৩৪টি এবং ইলেকট্রো মেকানিক্যাল ইন্টারলকিং (পরোক্ষ) সংকেতব্যবস্থা রয়েছে তিনটি স্টেশনে। এই অঞ্চলে নন-ইন্টারলকড মেকানিক্যাল ১৪টি এবং নন-ইন্টারলকড কালার লাইট ৮৩টি স্টেশনে আছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, দেশের রেল খাতে উন্নয়ন হচ্ছে শুধু অবকাঠামোভিত্তিক। যাত্রী পরিবহনের মূল জায়গায় তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। এক স্টেশনের সংকেতব্যবস্থার সঙ্গে অন্য স্টেশনের সংকেতব্যবস্থার কোনো মিল নেই। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বাড়ছে।

৪৩ জেলায় রেলপথ, ঝুঁকিতে ৩৯ জেলা

বর্তমানে দেশের ৪৩ জেলায় রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ছোট-বড় নানা সমস্যায় জর্জরিত ৩৯ জেলার রেললাইন। রেলের মান নষ্ট হওয়া, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, মাটি সরে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে দেশের প্রায় অর্ধেক রেললাইন ঝুঁকিতে পড়েছে। সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের করা এক সমীক্ষায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশে এখন রেলপথ আছে তিন হাজার ৯৩.৩৮ কিলোমিটার। আর রেললাইন আছে চার হাজার ৪৩৮.৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে রেলপথ আছে এক হাজার ৩৩৩.৯৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে মিটার গেজ এক হাজার ২৯৯.০৪ কিলোমিটার, ডুয়াল গেজ ৩৪.৮৯ কিলোমিটার। এই অঞ্চলে ব্রড গেজ রেলপথ নেই। আর পশ্চিমাঞ্চলে রেলপথ আছে এক হাজার ৭৫৯.৪৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে মিটার গেজ ৩৮০.৭৯ কিলোমিটার, ব্রড গেজ ৮৭৯.৮৫ কিলোমিটার, ডুয়াল গেজ ৪৯৮.৮১ কিলোমিটার।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, রেলের গতি বাড়াতে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু রেলের গতি বাড়ছে না। অনেক ক্ষেত্রে উল্টো গতি কমছে। রেললাইনগুলোর অবস্থা ভালো নয়। কোচ, লোকোমোটিভ, লাইন, সংকেত—সব জায়গাতেই ত্রুটি। দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে।

১২ বছরে ২৬০১ দুর্ঘটনা

রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ১২ বছরে রেললাইনে দুই হাজার ৬০১টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চলার পথে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৫৮টি। এসব দুর্ঘটনায় ৩৪৩ জন মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে ট্রেনের যাত্রী মাত্র ৩২ জন। আর রেলের কর্মী ৪৩ জন। এসব দুর্ঘটনায় ট্রেনের বাইরের মানুষের মৃত্যু হয় সবচেয়ে বেশি, ২৬৮ জনের।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ১১৬টি ট্রেন দুর্ঘটনায় এক হাজার ৩৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত এক হাজার ৩০২ জন। আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে এক হাজার ১২১টি দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৫৬ জন মারা গেছে। এতে আহত হয়েছে আরো ৫২২ জন।

জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রেলের শতাধিক প্রকল্পে লাখো কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন ও সেতু সংস্কার না করা, সংকেতব্যবস্থা আধুনিক না করায় রেলপথ দিন দিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ট্রেন পরিচালনার মৌলিক খাতে কাজ করা হচ্ছে না। ফলে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী রেলপথ দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

Show More

8 Comments

  1. I loved as much as you will receive carried out right here.
    The sketch is attractive, your authored material stylish.

    nonetheless, you command get bought an impatience
    over that you wish be delivering the following. unwell unquestionably come
    further formerly again as exactly the same nearly a lot
    often inside case you shield this increase.

    my web-site – vpn special coupon code (vpnspecialcouponcode.wordpress.com)

  2. Great blog! Do you have any hints for aspiring writers? I’m hoping to start my own website soon but I’m a little lost on everything.
    Would you advise starting with a free platform like WordPress
    or go for a paid option? There are so many choices out there that I’m completely overwhelmed ..
    Any recommendations? Kudos!

    Feel free to surf to my web site vpn definition

  3. It’s a shame you don’t have a donate button! I’d most certainly donate to this superb blog!
    I suppose for now i’ll settle for bookmarking
    and adding your RSS feed to my Google account. I look forward to brand new updates and will share this website with my Facebook group.

    Chat soon!

    Feel free to visit my blog post :: vpn special coupon code

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button