এইডডাটার গবেষণা: মার্কিন চাপের বিপরীতে চীনা ঋণের রেকর্ড
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মান নিয়ে বাংলাদেশকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে চাপ তৈরিতে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে চীনকে বড় বাধা বলে মনে করে দেশটি। কারণ পশ্চিমারা যখন চাপ তৈরি করে তখন চীন সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। পশ্চিমাদের প্রেক্ষাপটে এটি খুবই কঠিন পরিস্থিতি। কারণ তারা চীনের মতো সহযোগিতা করতে পারছে না। আবার পরিস্থিতিকেও মানতে পারছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক গবেষণা ল্যাব এইডডাটার সর্বশেষ গবেষণায় বাংলাদেশে চীনা ঋণের চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদে (২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত) চীনা ঋণের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
এইডডাটার প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্র সময় সোমবার সন্ধ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
এইডডাটা বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল। এখন সেই জায়গা নিয়েছে চীন। চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশই নয়, বিশ্বের একক বৃহত্তম ঋণদাতা দেশও চীন।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয় চীন। যুক্তরাষ্ট্র এখন চেষ্টা করছে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তার যে বিরাট ব্যবধান তা কমিয়ে আনতে। তবে শেষ পর্যন্ত তারা চীনের সঙ্গে পারবে কি না তা স্পষ্ট নয়।
বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো প্রভাব বিস্তার করতে চায়। আর চীনও চায় এই অঞ্চলে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী আচরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে তখন ‘কোমল শক্তির’ কূটনীতি নিয়ে বাংলাদেশে এগিয়েছে চীন।
এইডডাটার গবেষণায় দেখা গেছে, বিএনপি সরকারের (২০০২-০৬) তুলনায় আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০১৪ মেয়াদে দ্বিগুণ উন্নয়ন অর্থায়ন করেছে চীন। আবার ২০১৪-১৮ মেয়াদে তা সাত গুণ বেড়েছে। আওয়ামী লীগের চলতি মেয়াদে (২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত) চীনের ঋণ বা উন্নয়ন অর্থায়ন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
লুকানো ঋণ নেই
২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনের ঋণপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে এইডডাটা বলেছে, বাংলাদেশে চীনা ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৪.১ শতাংশ। এটি বৈশ্বিক চীনা ঋণের (৬.৯ শতাংশ) চেয়ে কম।
এইডডাটার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে চীনের লুকানো বা গোপনীয় কোনো ঋণ নেই। বাংলাদেশের চিত্র পাকিস্তান ও আর্জেন্টিনার চেয়ে আলাদা। অন্য ঋণ থেকে উদ্ধার পেতে বাংলাদেশকে চীনের কাছ থেকে সহায়তা নিতে হয়নি। এটি বাংলাদেশের সক্রিয় ঋণ ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ঋণসংকটের সম্মুখীন হয়নি।
বিআরআই থেকে উত্থান
চীনের কৌশলগত উদ্যোগ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বিভিন্ন দেশে ঋণ ও অর্থ সহায়তা প্রদানের চিত্র এইডডাটার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে বড় কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্য প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশকে তারা কেস স্টাডি হিসেবে নিয়েছে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড রিবুট শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিআরআইয়ের অধীনে বাংলাদেশে সাড়ে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার অঙ্গীকার করেছে চীন। এর মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশে একক বৃহত্তম বিদেশি ঋণ ও সহায়তাদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এই অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিআরআই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়। কভিড মহামারির সময়ও বাংলাদেশে চীনের সহায়তা অব্যাহত ছিল।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন এইডডাটার নির্বাহী পরিচালক ব্র্যাড সি পার্কস এবং প্রতিষ্ঠানটির চীনা ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্সের জ্যেষ্ঠ গবেষণা বিজ্ঞানী আম্মার এ মালিক। এইডডাটার অংশীদারি ও যোগাযোগ বিভাগের পরিচালক অ্যালেক্স উলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই প্রতিবেদনে আমরা বৈশ্বিক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলাদেশে চীনের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোকে বিশ্লেষণ করেছি।’
অ্যালেক্স উলে জানান, বিশ্বের ১৬৫টি দেশে চীনা অর্থায়নে পরিচালিত ২০ হাজারের বেশি প্রকল্প বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এইডডাটার তথ্য অনুযায়ী, চীনের বড় অঙ্কের ঋণ সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে ৩০তম এবং এশিয়ায় সপ্তম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে চীনের ঋণ সহায়তার অঙ্গীকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদেও তা অব্যাহত আছে।
এইডডাটার হিসাব অনুযায়ী, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০২ থেকে ২০০৬ সাল) প্রতিবছর গড়ে চীনের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদে তা বেড়ে ৩৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের টানা দ্বিতীয় মেয়াদে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০ কোটি মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ বিএনপির সময়ের প্রায় সাত গুণ। ২০১৯ সাল থেকে বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশ গড়ে প্রতিবছর ২৩০ কোটি ডলার ঋণ বা অন্যান্য সহায়তা নিয়েছে চীনের কাছ থেকে।
জনগণ ও গণমাধ্যমের মনোভাব
এইডডাটার গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী পর্যায়ে যাওয়ার বিষয়টিও স্থান পেয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত দুই মেয়াদে অব্যাহত উন্নয়ন সহযোগিতার কারণে চীনের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এবং গণমাধ্যমের ভেতরে ইতিবাচক মনোভাব বেড়েছে।
প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশিদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে এসে তা বদলে আবারও ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।
সহায়তার অর্ধেকই জ্বালানি খাতে
এইডডাটার হিসাব অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনের ঋণ ও অন্যান্য সহায়তার ৫০ শতাংশ এসেছে জ্বালানি খাতে। এটি মোট ঋণ সহায়তার প্রায় ১০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরিবহন ও সংরক্ষণাগার খাতে এসেছে ৩০ শতাংশ, যা প্রায় ৬.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শিল্প, খনিজ ও নির্মাণ খাতে এসেছে মোট সহায়তার ৯ শতাংশ।
শীর্ষ পাঁচ ঋণ প্রকল্প
বাংলাদেশে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প চীনের সবচেয়ে বড় ঋণ সহায়তা প্রকল্প। এইডডাটার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডলারের দর অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিবহন ও সংরক্ষণাগার খাতের ওই প্রকল্পের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ২.৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে।
এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে ২.১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ১.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে ১.১৩ ডলার। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পটুয়াখালী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশ চীনের এক্সিম ব্যাংক ও চীনা ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ০.৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে। অর্থাৎ ওই পাঁচ প্রকল্পে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ৮.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে।
৫৮ প্রকল্পের মধ্যে দুটি স্থগিত বা বাতিল
এইডডাটা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে চীনের ৫৮টি প্রকল্পের (২০.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) তথ্য তুলে ধরেছে। এর মধ্যে দুটি প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। এইডডাটা মনে করে, ৫৯ শতাংশ প্রকল্পেই পরিবেশ, সামাজিক ও শাসনগত (এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স, সংক্ষেপে ইএসজি) সুরক্ষার ঘাটতি আছে।