এ্যানিকে ‘দরজা ভেঙে’ গ্রেপ্তারের পর ‘থানায় পেটানো’র মাধ্যমে সরকার কী বার্তা দিল
‘রাত ১২টার সময় ধরে নেওয়া কেন? কোথায় রাখবে তাকে? বাংলাদেশের থানা হাজতগুলো তো কিছুক্ষণের জন্যও কাউকে রাখার উপযুক্ত না।’
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক–নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের প্রতিনিধিদলের উপস্থিতির ভেতরেই গত মঙ্গলবার বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্যসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে গভীর রাতে পুলিশ ‘বাসার দরজা ভেঙে’ গ্রেপ্তার করে।
পরের দিন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে রিমান্ড শুনানি চলাকালে এ্যানি তাকে গ্রেপ্তারের পর থানায় ফেলে বেধড়ক পেটানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। আদালতের সামনে এ নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদেও ফেলেন বিএনপির এই নেতা।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান এবং সতর্কতার পরেও এ্যানিকে গ্রেপ্তার ও তাকে নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়টি আসলে কী বার্তা দিচ্ছে?
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সু্প্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এবং বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে।
এ ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার ভাষ্য, এ্যানি তাকে নির্যাতনের যে অভিযোগ তুলেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে, তা ২০১৩ সালের হেফাজতে নির্যাতন আইন বিরোধী।
তিনি বলেন, ‘এগুলো তো আমরা বলে আসছি। এ্যানি তো পুরুষ; ভিকারুননিসা স্কুলের এক মিসট্রেসকে বছর পাঁচেক আগে উত্তরার বাসা থেকে ধরে নিয়ে এসেছিল রাত ১২টার সময়। তিনি যদি অপরাধী হয়ও থাকেন, তারপরও রাত ১২টার সময় ধরে নেওয়া কেন? কোথায় রাখবে তাকে? বাংলাদেশের থানা হাজতগুলো তো কিছুক্ষণের জন্যও কাউকে রাখার উপযুক্ত না।’
মধ্যরাতে বাসার দরজা ভেঙে এ্যানিকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে তার বক্তব্য, ‘তার (শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি) নামে মামলা ছিল, মেনে নিলাম। কিন্তু দরজা ভেঙে ধরার দরকার তো ছিল না। সারারাত ঘেরাও দিয়ে বসে থাকলেই তো হতো।’
‘এগুলো আছে বলেই কিন্তু গুম-খুনের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। ক্রসফায়ার হচ্ছে। প্রায় প্রত্যেকটা ক্রসফায়ারের ঘটনাই দেখবেন মধ্যরাতের,’ যোগ করেন তিনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও জনসাধারণের আইনি সুরক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে এই আইনজীবীর বক্তব্য হলো, ‘এখানে মানুষের স্বাধীনতা দোদুল্যমানও না, আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় আছে। প্রেম নিবেদন করতে গেলেও চিন্তাভাবনা করতে হবে। আপনি এক কলম লিখবেন—দশবার চিন্তাভাবনা করতে হবে। কোথাও কোনো বক্তব্য রাখবেন—দশবার ভাবতে হবে।’
‘এখানে যদি সুবিচার বা ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা থাকত, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ পুলিশ ও আদালতকে নিরাপদ মনে করত। তারা সেটা করে না। এর অর্থ হলো সুশাসন নেই, দুঃশাসন চলছে।’
এ্যানিকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানের বক্তব্য, ক্ষমতাসীন দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে একটি সুনির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতেই এমন কাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি চাপ এবং ভিসা নীতি—এসবে (ক্ষমতাসীন দলের) মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভেতর একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে সামনে হয়তো কোনো দুঃসময় অপেক্ষা করছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের চাঙ্গা করার বিষয়টি খুব জরুরি। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা সবাইকে এই বার্তাটা দিতে চাচ্ছে যে, আমরা কিন্তু আগের মতোই আছি।’
তানজীমউদ্দিন খান আরও বলেন, ‘ভিসা নীতির কারণে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে, বিষয়টা এমন না। কেননা আমরা যে ধরনের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে আছি, তাতে একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে শুরু করে একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত কেউ কোনো ন্যায্যতা নিশ্চিত করে না। অন্যায্যতা, দুর্নীতি, মাস্তানি—বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা যে ভাষায় কথা বলছেন সেটা খুবই আক্রমণাত্মক। তাতে মনে হচ্ছে আমরা সংঘাতকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যে অবস্থানই নিক না কেন, তারা এগুলোকে তোয়াক্কা করছেন না। এটা বোঝানোর জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রতিনিধি দল ঢাকায় অবস্থানকালেই তারা এ ধরনের কাজ করছে।’
এ্যানিকে নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, ‘যে উপায়ে থানায় তার ওপর অনাচারটা করা হলো, সেটা খুব ভালো কিছুর ইঙ্গিত না। আর যে ভাষায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কথা বলছেন, তাতে সংঘাতটাকে হয়তো তারা অবশ্যম্ভাবী করে তুলছেন।’
বিএনপি নেতা মাহবুব উদ্দিন খোকন বলছেন, ‘এটা আওয়ামী লীগের একটা রুটিন ওয়ার্ক। প্রত্যেক নির্বাচনের আগেই তারা এভাবেই আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে।’
গ্রেপ্তারের রাতেই মাহবুব উদ্দিন খোকন থানায় গিয়ে এ্যানির সঙ্গে দেখা করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা (পুলিশ) রাত দেড়টার সময় (এ্যানির বাসায়) গিয়েছিল। তিনি (এ্যানি) বলছিল যে আপনারা ভোরে আসেন। কিন্তু তারা তা মানেনি। এরপর তারা দরজা ভাঙল; মিসবিহেব করেছে; টানাহেঁচড়া করে গাড়িতে উঠিয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়াই অবৈধ। মনে হয় এর মধ্য দিয়ে সরকার বিদেশিদের তাদের শক্তি দেখাল।’
থানায় নেওয়ার পর সেখান থেকে এ্যানিকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার দাবি করে এই আইনজীবী বলেন, ‘ডিবিকে এই ধরনের তদন্তের আদেশ একমাত্র আদালতই দিতে পারে বা সরকার দিতে পারে। এ্যানির বিরুদ্ধে যে মামলা, তা পেনাল কোডের মামলা। ডিবিকে এটা তদন্ত করতে দেওয়া হয়নি। তাই থানা থেকে তাকে যেভাবে ডিবিতে নেওয়া হলো, সেটা পুরোপুরি অবৈধ।’
মাহবুব উদ্দিন খোকনের ভাষ্য, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে এসব করল আরকি। এটা ইলিগ্যাল। থানা থেকে আপনি কাউকে ডিবি অফিসে নিতে পারেন না। ডিবি যদি কাউকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে, তাহলে তাকে থানায় দিতে হবে। এখানে উল্টো হয়েছে।’