ওষুধে মুনাফার মহোৎসব
দুই মাসে দেশের বিভিন্ন কোম্পানি তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়েছে। অন্তত ৫০ ধরনের ওষুধের দাম ২০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। চলতি মার্চের প্রথম সপ্তাহেও দাম বাড়ানো হয়েছে বেশ কয়েকটি ওষুধের।
সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট, ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন ও ইনজেকশনের দাম। এ ছাড়া হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, হাঁপানিসহ বিভিন্ন ওষুধ এবং ভিটামিনের দামও বেড়েছে। বাদ যায়নি জ্বর-সর্দির ট্যাবলেট-ক্যাপসুল, বিভিন্ন অসুখের সিরাপও।
বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং বিক্রি থেকে আয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দাম বাড়ানোর হার অস্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে কোম্পানিগুলো ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছে। এ সময় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘লাগাতার ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নেব। তবে এ বিষয়ে ঠিক এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারব না। ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালককে বলেছি, এমন অস্বাভাবিকভাবে কেন ওষুধের দাম বাড়ছে, সেই বিষয় খতিয়ে দেখে আমাদের জানানোর জন্য। যাতে আমরা ওষুধের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে পারি, তার জন্য কাজ করব।’
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২ মার্চ একটি শীর্ষ কোম্পানি তাদের উৎপাদিত ওষুধগুলোর মধ্যে ২৪টির দাম বাড়িয়েছে। এর মধ্যে ক্যাপসুল ট্রিওসিম ২০০-এর দাম প্রতিটি ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ বা ১০ টাকা বাড়িয়ে ৪৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া কোম্পানিটির উৎপাদিত ট্যাবলেট মনোকাস্ট, ক্যাপসুল নার্ভালিন, ট্যাবলেট রিলেনটাস, ফ্যামোম্যাক্সসহ বিভিন্ন ওষুধের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমাসহ ফুসফুসের রোগে ব্যবহার হয় এ কোম্পানির ট্যাবলেট ফিক্সোলিন। ৪০০ মিলিগ্রামের এই ওষুধের প্রতি পিসের দাম গত ফেব্রুয়ারি মাসেও ৫ টাকা ছিল। কিন্তু এক ধাক্কায় এর দাম ১৪০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১২ টাকা।
গত ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি কোম্পানির উৎপাদিত ১১টি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাদের ওষুধের দাম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে ৩০ পিসের এরিস্টোগোল্ড ট্যাবলেটের প্যাকেটের দাম ২৭০ থেকে ৩৯০, স্টাফেন ২৫০ থেকে ৪০০, অ্যারোডিন সলিউশন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা করা হয়েছে। এর আগেও কোম্পানিটি বিভিন্ন সময়ে তাদের ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে। একইভাবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি তাদের উৎপাদিত এমব্রোক্স, সেফোটিল, সেফ-৩, সেফট্রোন, ক্লোফেনাকসহ ২৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। অন্যান্য ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিও একইভাবে দাম বাড়াচ্ছে।
বিভিন্ন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, এক বছরে ওষুধের কাঁচামালের দাম গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে গত দুই বছরে ডলার, কাঁচামাল ও জ্বালানির দাম যতটা না বেড়েছে, এর চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম।
ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে জনসাধারণের ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক জরিপ অনুযায়ী, চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশই এখন ওষুধের পেছনে খরচ হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর লাগামহীন দর বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের অনেকেই জরুরি প্রয়োজন না হলে ওষুধ কিনছে না।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের প্রায় সব খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল ও জ্বালানির দাম বাড়ায় সব কোম্পানির উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। অনেক কোম্পানির মুনাফা ব্যাপক হারে কমে গেছে, কোনো কোনো খাতের কোম্পানি পড়েছে লোকসানে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায় সব ওষুধ কোম্পানি দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতার এমন সময়ে উচ্চ মুনাফা বজায় রেখেছে। ২০২২-২৩ হিসাববছরে দেশে ওষুধের মার্কেট সাইজ ছিল সাড়ে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। গড়ে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ওষুধের বাজারের।
২০২২-২৩ হিসাববছরে একটি ওষুধ কোম্পানির আয় ছিল ৬ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। দেশের ওষুধের বাজারের ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ হিস্যা রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির। তিন বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে ২৭ শতাংশ। ২০১৯-২০ হিসাববছরে তাদের নিট মুনাফা ছিল ১ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ হিসাববছরে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা।
১৯৮১ সালে দেশে ১৬৬টি ওষুধের কারখানা ছিল এবং সে সময় দেশের ওষুধের বাজারের ৭৫ শতাংশ হিস্যা ছিল আটটি বহুজাতিক কোম্পানির। সরকারের কর সুবিধা, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে আনা ও অন্যান্য প্রণোদনায় দেশীয় ওষুধশিল্প বর্তমানে ঈর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছে। চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ এখন দেশেই উৎপাদিত হয় এবং দেশীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একে একে বিদায় নিয়েছে। বর্তমানে ১৬০টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।
চলতি মার্চে বিভিন্ন ওষুধের দাম ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা একটি কোম্পানি ২০২২-২৩ হিসাববছরে ৪৬১ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে, যা ২০১৯-২০ হিসাববছরের চেয়ে ৩১ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০২০-২১ হিসাববছরে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ৫১৭ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চলতি ২০২৩-২৪ হিসাববছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ। আর নিট মুনাফা বেড়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। এখন এই কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের দাম বাড়ায় নিট মুনাফা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
তিন বছরের ব্যবধানে আরেকটি কোম্পানির নিট মুনাফা প্রায় ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্য আরেকটি কোম্পানির ২০২২-২৩ হিসাববছরে মুনাফার প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও চলতি ২০২৩-২৪ হিসাববছরে উচ্চ মুনাফায় ফিরেছে। চলতি হিসাববছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯-২০ হিসাববছরে অন্য একটি কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ১৪৪ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ হিসাববছরে দাঁড়িয়েছে ২৩০ কোটি টাকায়। তিন বছরে কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। চলতি প্রথমার্ধেও উচ্চ মুনাফার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে তাদের।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি জীবনরক্ষাকারী ২৭ হাজারের বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় আছে মাত্র ২১৯টি। এর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্যান্য ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। অথচ একসময় ২০০-এর বেশি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার। কিন্তু সেই সংখ্যা এখন আরও কমেছে।
১৯৮২ সালের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। অথচ এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে ২০২২ সালে কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়া শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর সুপারিশে ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয় ঔষধ প্রশাসন। সে সময় প্যারাসিটামল এবং হৃদরোগ, ব্যথানাশক ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের দাম ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সেই দাম বাড়ার রেশ না কাটতেই গত বছরের মে মাসে আবার শীর্ষ ছয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ২৩৪টি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ওষুধের দাম, ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে দাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘দেশে যেহেতু সব পণ্যের দামই বাড়ছে, তাই ওষুধের দাম বৃদ্ধিও স্বাভাবিক। তবে ওষুধ আর অন্য পণ্যের দাম বাড়ার মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। যেহেতু সব পণ্য থেকে ওষুধ আমাদের কাছে অন্য রকম গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়লে একটির পরিবর্তে অন্য পণ্য খেয়ে জীবনধারণ করতে পারি। কিন্তু ওষুধের দাম বাড়লে এর অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।’
তিনি বলেন, রোগ মুক্তির জন্য মানুষকে ওষুধ সেবন করতে গিয়ে তাদের খাদ্যাভ্যাস কিংবা জীবন ধারণের জন্য অন্যান্য জায়গায় ছাড় দিতে হচ্ছে। অনেকের পক্ষে বাড়তি ব্যয় বহন করতে না পারলে তাকে ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ওষুধের দাম কমিয়ে আনতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার মতো নীতিনির্ধারণী সুবিধা দিতে পারে সরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর কিংবা ওষুধশিল্প সমিতিও উদ্যোগ নিতে পারে, যাতে অস্বাভাবিক হারে দাম না বাড়ে। কোম্পানিগুলো মার্কেটিং, প্রমোশনে ব্যয় কমিয়ে আনতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষকে বেশি ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
ওষুধ কোম্পানিগুলোর একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এক বছরে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে কাঁচামালের (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্টস- এপিআই) দাম। ২০২২ সালের পর থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনবার ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। ডিজেলের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। বিপণনের খরচ বাড়ার পাশাপাশি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও বেড়েছে। এসব কারণে উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। ওষুধের দাম বাড়ার এটিই প্রধান কারণ।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও বিক্রি থেকে আয় বাড়ায় ওষুধ কোম্পানিগুলো উচ্চ মুনাফা বজায় রেখেছে। ২০২৩-২৪ হিসাববছরের প্রথমার্ধে শীর্ষ এক ওষুধ কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি থেকে আয়ের ৫০ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে আরেকটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বিক্রি থেকে আয়ের ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের প্রথমার্ধেও একই ছিল।