Bangladesh

কৃষি ছাড়ছেন কৃষকরা

সামাজিক বৈষম্য, আর্থিক নিরাপত্তার ঘাটতি, খাদ্যপণ্যের আমদানিনির্ভরতা ও কৃষি খাতে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে কৃষকরা তাদের পেশা ছাড়ছেন। ফলে নিকট ভবিষ্যতে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে ১১ বছরের ব্যবধানে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে কৃষকের সংখ্যা। অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে কৃষিজমি কমে যাওয়া, কৃষি উপকরণের দাম বাড়া, বীজ ও সারে আমদানিনির্ভরতার কারণে দামের অস্থিরতা প্রভৃতি কারণে কৃষিতে আগ্রহ কমছে কৃষকদের।

২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী ১০ বছর বা তার বেশি বয়সী নাগরিকদের ৩৭ দশমিক ৯১ শতাংশ কৃষিশ্রমিক, অথচ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এ হার ছিল ৪৭ দশমিক ০৩ শতাংশ। ১১ বছরে

কৃষক কমেছে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ। শুধু কৃষিতেই শ্রমিক কমেছে। শিল্প ও সেবা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে শ্রমিক বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহ গণনা ২০২২-এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে কৃষিশ্রমিক কমে যাওয়ার এ কথা বলা হয়েছে।

কৃষিবিদরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ এসব কারণে কৃষিতে আগ্রহ কমছে চাষিদের। বৈশ্বিক একটি প্রথাকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন তারা। সেটি হলো, বাবা কৃষিকাজ করলেও সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আর কৃষিতে ফিরতে চান না। মানুষ যত বেশি শিক্ষিত হচ্ছেন তত বেশি কৃষিবিমুখ হচ্ছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু শিক্ষিত তরুণ বাণিজ্যিক কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বলে মনে করেন কৃষিবিদরা।

কৃষিজমিতে সরকারি প্রকল্প না করার কথা প্রধানমন্ত্রী বললেও কৃষিজমিতে সরকারি প্রকল্প হাতে নেওয়ার হার দিন দিন বেড়েই চলছে। বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে। এতে কৃষকরা জমি হারিয়ে ভিন্ন পেশায় ঝুঁকছেন।

কৃষিতে কৃষকের আগ্রহ কমলেও উৎপাদন বাড়ছে প্রতি বছরই। বিবিএসের হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাটের মোট উৎপাদন হয়েছে ৮৪ লাখ ৫৭ হাজার ৬৭৪ বেল, যা ২০২১-২২ এর চেয়ে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমনের ফলন আগের বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ১২৯ শতাংশ বেশি। গমের উৎপাদন আগের বছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৭৬৯ শতাংশ বেশি। আলুর উৎপাদন বেড়েছে ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বোরোর উৎপাদন বেড়েছে ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

কৃষকরা পেশা ছেড়ে দেওয়ার ব্যাখ্যায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘অনেক কারণ। তারা কৃষি ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন। একসময় কৃষি সম্ভাবনাময় পেশা ছিল। বর্তমান সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আগে আগাছা পরিষ্কারে ১০ জন লোক লাগত, এখন লাগে দুই-একজন; ধান মাড়াইয়ে যেখানে ১০ জন লাগত, এখন এক বা দুজন তা করেন মেশিনে। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ কৃষিতে কৃষকদের সংশ্লিষ্টতা কমিয়েছে। তারা অন্য পেশায় চলে গেছেন বা যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘আরেকটি বৈশ্বিক কারণে কৃষক কমছে। সেটি হলো কৃষকের ছেলে কৃষিতে আসতে চান না, তারা এখন এটিকে সম্মানজনক পেশা মনে করেন না। যারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ-ি পার হয়েছেন বা এসএসসি পাস করেছেন তারা আর কৃষিতে থাকতে চান না। প্রয়োজনে বিদেশে গিয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।’

তরুণ জনগোষ্ঠী একটা অংশ অবশ্য নতুন করে কৃষিতে ফিরেছেন। তাদের সংখ্যা খুব কম। কৃষিবিদ ড. আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘তারা এটিকে প্রথাগত কৃষি হিসেবে দেখেন না। তাদের ভাষায় এটি কৃষি প্রজেক্ট। তারা নিজেদের উদ্যোক্তা ভাবেন। ব্যবসায় যেমন বিনিয়োগ হয় এখানেও তারা বিনিয়োগ মনে করেন। ব্যবসায় যেমন কর্মচারী থাকে এখানেও তার কর্মচারী থাকে। বাণিজ্যিক কৃষির একটা নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। শিক্ষিত তরুণরা কৃষিতে বাণিজ্যিকভাবে ফিরেছেন। তবে প্রান্তিক কৃষকরাই কৃষির সিংহভাগ জোগান দেন।ন জিডিপিতে ধারাবাহিকভাবে কৃষির অবদান কমলেও কৃষির উৎপাদন কিন্তু বাড়ছে। অন্য খাতগুলো ভালো করছে, এটিও কৃষকের সংখ্যা কমার কারণ।’

তিনি মনে করেন, কৃষিবিমুখ হয়ে কেউ যদি বেকারত্ব বাড়ান সেটি কৃষির জন্য ভালো নয়। বরং কৃষিতে থেকে বেকারত্ব কমানো হলে তা ভালো। কৃষির যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে এবং তা বাড়ছে। দরকার পরিকল্পনার সমন্বয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের কৃষি খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বড় বড় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফসল নষ্ট হওয়ায় হতাশ কৃষকরা কৃষিবিমুখ হচ্ছেন। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যমতে, গত চার দশকে ভোলা দ্বীপের প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার উঁচু হতে পারে, ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮ দশমিক ৩ অংশ নিমজ্জিত হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্রমতে রাজশাহীর উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯১ সালে পানির স্তর ছিল ৪৮ ফুট নিচে, ২০০০ সালে তা নেমেছে ৬২ ফুটে, ২০০৭-এ নেমেছে ৯৩ দশমিক ৩৪ ফুটে। বর্তমানে বন্যার সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বেড়েছে।

বরেন্দ্র ও হাওর এলাকা দেশের সিংহভাগ চালের জোগান দেয়। বর্তমানে এসব অঞ্চলের জমিতে ধানচাষের বদলে অন্যান্য কৃষিকাজের প্রবণতা বেড়েছে। প্রান্তিক ভূমি মালিকদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা কৃষিজমি ১০ থেকে ৩০ বছরের জন্য লিজ নিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা চাষ করছেন ড্রাগন, পেয়ারা, উফশী জাতের আম, কমলা, মাল্টা, লেবু এবং অন্যান্য ফল ও মসলা। আগে প্রান্তিক কৃষকরা এ জমিতে বছরে তিনটা ফসল ফলাতেন।

ড. আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘জলবায়ুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের যে জমিতে কৃষি হতো সে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসল ফলানো কঠিন। ফলে কৃষকরা কৃষি থেকে অন্য খাতে চলে গেছেন। বরেন্দ্র এলাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে তারা ধান ছেড়ে আম চাষের দিকে গেলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পরিবর্তন লক্ষণীয়। কোথাও খরা, কোথাও জলাবদ্ধতা, কোথাও লবণাক্ততা।

দেশের কৃষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নেই। এ কৃষিবিদ বলেন, এখানে শস্যবীমাও নেই। চাষিদের কৃষি নিরাপত্তা, আর্থিক নিরাপত্তা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে আমরা সপ্তম অবস্থানে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। আরেকটি পূর্বাভাস আছে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। প্রবল বৃষ্টিপাতও হতে পারে। ওই সময় আলুর মৌসুম। ফসল উৎপাদনে অনিশ্চয়তার কারণেও অনেকে কৃষি ছাড়ছেন বা ছাড়তে চান।

কৃষি খাতে শ্রমিক কমলেও উল্লেখযোগ্য হারে শিল্প ও সেবা খাতে শ্রমিক বেড়েছে। ২০২২ সালে শিল্প খাতে শ্রমিকের হার ছিল ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ, ২০১১ সালের শুমারিতে তা ছিল ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। শিল্প খাতে শ্রমিক বেড়েছে ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

সেবা খাতেও শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২২ সালের শুমারিতে সেবা খাতে শ্রমিকের হার দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ২০১১ সালে এ হার ছিল ৩৮ দশমিক ০৪ শতাংশ। ১১ বছরে এ খাতের শ্রমিক বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ (১৪.৮২%)।

বিবিএস বলছে, সেবা খাতে কর্মরত মোট জনগোষ্ঠীর ৮৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ পুরুষ ও ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ নারী। অন্যদিকে কৃষি খাতে কর্মরতদের মধ্যে ৮০ দশমিক ৯১ শতাংশ পুরুষ, ১৯ দশমিক ০৯ শতাংশ নারী, শিল্প খাতের ৮০ দশমিক ১৭ শতাংশ পুরুষ ও ১৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ নারী। সেবার তুলনায় কৃষি ও শিল্প খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি।

গ্রাম ও শহরের পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেবা খাতে কর্মরতদের ৫১ দশমিক ৫০ শতাংশ গ্রামে বাস করেন, ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ শহর এলাকায় বাস করেন। কৃষি খাতে কর্মরতদের ৮৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ গ্রামে, ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ শহরে কৃষিকাজ করেন।

বর্তমানে ধানের মূল্য অন্য কৃষিপণ্যের চেয়ে কম। তাই বড় বড় কৃষি খামারিরা ধান উৎপাদনের চেয়ে অন্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে আগ্রহী। উফশী জাতের ধান আসার পর যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল তা আর হচ্ছে না। কৃষির উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় প্রান্তিক কৃষকরা পুঁজির অভাবে চাষাবাদ থেকে সরে যাচ্ছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto