Bangladesh

ক্ষমতার দম্ভে আ.লীগে সংঘাত

বিএনপির মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ভোটযুদ্ধ করতে হয়নি আওয়ামী লীগকে। বিএনপি ভোট বর্জন করায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার বিদেশি চাপ সামাল দিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামানো হয় আওয়ামী লীগকেই। যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন, তাদের স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচন করার অনুমতি দেওয়া হয়। এখন এ দুপক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শক্তির দম্ভের কারণে সরাসরি সংঘর্ষ বা প্রতিশোধমূলক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সংঘাত-সহিংসতা বন্ধে দলের স্বার্থের বিষয়টিও চিন্তা করছে না বিবদমান দুপক্ষ।

দীর্ঘস্থায়ী এ সহিংসতা বন্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আওয়ামী লীগের চুপ করে থাকার সমালোচনা করছেন দলটির একাংশ। তারা বলেন, এ সহিংসতা বন্ধে আওয়ামী লীগ একটিও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে? দেয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে।

এ অংশের দাবি, এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অগ্রাধিকার তালিকার ১০ নম্বরে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে নিজের দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা দমনে কার্যকারিতা না থাকলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দলটির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয় ২১৯টি আসনে। এর মধ্যে প্রায় ১৩০ আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে স্বতন্ত্ররা। আওয়ামী লীগে নেতাকর্মীরাই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করেন প্রকাশ্যে। জয়ের নিশ্চয়তা পেতে মারামারি-হানাহানিও ঘটে।

মাদারীপুরের একটি উপজেলার শীর্ষ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শুধু মার খেয়ে যাব! শোধও নিতে হয় কখনো কখনো।’

মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘জেলায় এমপি রাজত্ব বেশি। আমি দলীয় নেতা হলেও এমপিরা সহনশীলতা না দেখালে সহিংসতা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই।’

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোটের অংশগ্রহণে ২০০৮ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা বলা যায় তিন দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর যাই ঘটেছে, এ সময়ের মধ্যে ঘটে গেছে। আতঙ্ক দূর করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন সব মত-পথের কর্মী-সমর্থকরা। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা এতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। এ সহিংসতায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই খুন করছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে। বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুরের ঘটনা তো ঘটছেই; হামলা থেকে দলীয় কার্যালয়ও রেহাই পায়নি।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) নামের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী একটি সংগঠন গত বুধবার জানিয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সহিংসতায় সারা দেশে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে ২ হাজার ২০০ জন আহত ও শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে ৩৫০টির বেশি গৃহ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার তথ্য জানিয়েছে সংগঠনটি। এসব ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের বিজয়ী বা পরাজিত পক্ষের নেতাকর্মীরা জড়িত। ভোটগ্রহণের দিন কমপক্ষে ৫০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে এইচআরএসএস। এদিন মুন্সীগঞ্জ, বরগুনা এবং কুমিল্লায় তিনজন নিহত এবং দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন। এর মধ্যে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

গতকাল শুক্রবারও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালীসহ অন্তত ২০টি জেলায় সহিংসতার রেশ রয়ে গেছে। এসব জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থকদের ভেতরে আতঙ্ক-আশঙ্কা তো রয়েছেই, সাধারণ মানুষও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার আতঙ্কে ভুগছেন।

গত সোমবার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহিংসতা বন্ধে এবং দলের বিরুদ্ধে দলের নেতাদের সমালোচনা-মারামারি এসব না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু এসব ঘটনা থামেনি। ভোট শেষ হওয়ার ১৩ দিন পার হলেও আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগে সহিংসতা এখনো চলছে।

বিএনপির মতো বড় দল নির্বাচনে নেই তবুও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা এত দীর্ঘস্থায়ী রূপ ধারণ করার কারণ কী, সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে উঠে এসেছে ক্ষমতার দম্ভের কথা। সবাই সবার ক্ষমতা জানান দিতে গিয়ে দলের ভেতরে দলাদলির অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়েই চলেছেন। এসব ঘটনায় দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে, সেই ভাবনা করোর মধ্যেই নেই। কোনো জেলায় ভোটের আগে নৌকার প্রার্থীর পক্ষের নেতাকর্মীরা ক্ষমতা দেখিয়ে হামলা-সংঘর্ষ করেছেন। ভোটের পরে সেসব জেলায় নৌকাকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে প্রতিশোধের পথে হাঁটছেন। মূলত সহিংসতার দীর্ঘস্থায়ী রূপ ধারণ করেছে ক্ষমতা আর পাল্টাপাল্টি শোধ নেওয়ার এমন মনোবৃত্তির কারণে।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের এক ডজন নেতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় নেতা ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়েছেন এবং যারা পরাজিত হয়েছেন তাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কথা হয়েছে তাদের অনুসারীদের সঙ্গেও। সবার বক্তব্য হলো, ‘ক্ষমতা আমার, আমি কেন মার খাব’ এ দম্ভই মূলত সহিংসতার কারণ। তারা বলেন, দলীয়ভাবে এখনো কড়া কোনো বার্তা না আসায়ও আরেকটি কারণ।

টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, ‘ভোটের আগে যা হয়েছে সেগুলো এড়িয়ে গেলেও ভোট-পরবর্তী সহিংসতার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপে যেতে হবে। তা না হলে দল দুর্বল হবে। শৃঙ্খলা থাকবে না।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা বন্ধে লাগাম টানা সম্ভব না হলে দল আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের ক্ষতিটুকু হয়তো টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ক্ষমতাই শেষ কথা নয়, রাজনীতি সংগঠন এসবের দিকেও নজর রাখতে হবে।’

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, কোনো কোনো অঞ্চলে সহিংস ঘটনার পেছনে দলের ও সরকারের ক্ষমতাবান নেতারাও জড়িয়েছেন। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে বেশ কিছু ‘পাওয়ার হাউজ’ তৈরি হয়েছে। এই ‘পাওয়ার হাউজের’ কাছে দলের নেতাদের নির্দেশনা তুচ্ছ হয়ে গেছে।

সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য ক্ষমতাবান এক নেতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, এলাকায় ওই নেতা অনুসারীকে উৎসাহিত করছেন এভাবে ‘সরকার চালাই আমি, পুরো বাংলাদেশ আমি চালাই। আমার অনুসারী মার খাবে কেন?’ চট্টগ্রাম বিভাগের এই নেতা তার এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ নেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা এখনো অব্যাহত থাকলেও কেন্দ্র থেকে কঠোর কোনো নির্দেশনা যায়নি। কেন যায়নি এর কোনো কারণ তার জানা নেই। আক্ষেপ করে তিনি শুধু বলেন, ‘সবকিছুতেই বিশৃঙ্খলা!’

তবে কড়া বার্তা না দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) গত সোমবার অনুষ্ঠিত যৌথসভায় সবাইকে শান্ত থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন।’

এসব ঘটনার সবই যে রাজনৈতিক বা নির্বাচনী সহিংসতা তা মানতে নারাজ আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি বলেন, ‘পারিবারিক, সামাজিক ও বংশীয় ঝামেলাগুলোও এখানে কাজ করছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button