গতি নেই চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পে, বাড়তি ব্যয় এক হাজার কোটি টাকার বেশি
১ বছর বাড়িয়ে ৪ বছরে অগ্রগতি ২০-২৫ শতাংশ, আরও ২ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব * শুরুতেই গলদ থাকার খেসারত দিতে হচ্ছে
গতি নেই দেশের ৮টি বিভাগের পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার, হৃদরোগ, কিডনি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পে। জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এর আওতায় ৩ হাজার ৫৩৪টি শয্যা তৈরির উদ্যোগ ছিল। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও সেটি হয়নি। মেয়াদ বাড়িয়েও চার বছরে অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০-২৫ শতাংশ। এখন নতুন করে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাবে বাড়তি খরচ হবে ১ হাজার ১৮২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৪৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। সেই সঙ্গে দুই বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য ‘৮টি বিভাগীয় শহরে পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার, হৃদরোগ এবং কিডনি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধনীর জন্য পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। ১৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শনিবার বলেন, স্থান নির্বাচনের জটিলতায় যদি এক বছর চলে যায়, তাহলে তো গোড়ায় গলদ ছিল। এর খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। যেনতেনভাবে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে কীভাবে অপূর্ণাঙ্গ নকশায় প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে আসে? আবার পরিকল্পনা কমিশন কীভাবে অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে? পাশাপাশি একনেকে অনুমোদনই বা হলো কীভাবে? ওই সময়ের অবহেলার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হলে ২০২২ সালের রেট শিডিউল লাগত না। ফলে ব্যয়ও হয়তো বাড়াতে হতো না। এককথায় বলা চলে পুরো প্রক্রিয়াতেই গলদ ছিল।
সূত্র জানায়, ‘৮টি বিভাগীয় শহরে পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার, হৃদরোগ এবং কিডনি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৮৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এখন নতুন করে ১ হাজার ১৮২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩ হাজার ৫৭০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর। কিন্তু এ মেয়াদে কাজের তেমন অগ্রগতি হয়নি। ফলে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। সেই মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এখন দ্বিতীয় সংশোধনীতে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ২ বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। তবে ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও সেটি হয়নি। এখন সংশোধনী প্রস্তাবে উত্তরার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের নাম দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় বিল্ডিং ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এটির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো কিডনি, ক্যানসার, হৃদরোগ প্রাথমিক পর্যায়েই চিহ্নিত করা। এছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ওইসব রোগের চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা এবং রোগীর নিজস্ব টাকার ব্যয় কমানো। এছাড়া বিদেশনির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি দেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
এটি সংশোধনের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে-মূল প্রকল্পটি বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল হাসপাতালে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার হাসপাতাল স্থাপন নামে অনুমোদন পায়; কিন্তু পরবর্তী সময়ে শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে ১৮২টি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এতে হৃদরোগ ও কিডনি সেন্টার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া স্থান নির্বাচনে জটিলতার কারণে প্রকল্পটি শুরু করতেই এক বছর চলে যায়। পরবর্তী সময়ে কোভিড-১৯-এর কারণে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যায়নি। এবার নতুন অঙ্গ যোগ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রকল্পটি যখন অনুমোদন পায়, তখন ২০১৮ সালের রেট শিডিউল ছিল। ফলে তখন সে অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু এখন ২০২২ সালের রেট শিডিউল কার্যকর হয়েছে। পাশাপাশি নকশায় কিছু পরিবর্তন হওয়ায় অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, চার বছর শেষ হলেও প্রকল্পের অগ্রগতি ২০ শতাংশ। প্রস্তাবিত অতিরিক্ত ২ বছরে প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা দিতে হবে। আউটসোর্সিং খাতে ক্লিনার নিয়োগের জন্য অর্থ বিভাগের সুপারিশ না থাকলেও একজনের ৩৬ মাসের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নতুন করে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এ খাতটি বাদ দেওয়া যেতে পারে। ব্যবহার্য দ্রব্যাদি খাতে আরডিপিপিতে নতুন করে ১০ লাখ টাকা ধরা হয়। বৈঠকে প্রশ্নের মুখে পড়ে এ খাতের ব্যয়সহ নানা বিষয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী সম্প্রতি বলেছেন, যে কোনো প্রকল্পের কাজগুলো যদি নির্ধারিত সময়ে শুরু ও শেষ হতো, তাহলে হয়তো বাড়তি টাকা নাও লাগত। সেই সঙ্গে তখন যে ‘কস্ট বেনিফিট’ অ্যানালাইসিস করা হয়েছিল, এখন সেটি অকার্যকর হবে। সময়মতো প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে যে সুবিধা বা সুফল মিলত, এখন তা পেতে অপেক্ষা করতে হবে। সবদিক থেকেই দেখা যাচ্ছে জনগণের করের টাকা অপচয় বা অপব্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দায়ী করতে হবে। পাশাপাশি যাদের কারণে দেরি হয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।