Bangladesh

ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণ বেড়েছে ৩ গুণ: মূল্যস্ফীতির হারে আরও চাপ বাড়ার শঙ্কা

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ঋণ নেওয়ার রেকর্ড গড়েছে সরকার। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। আগের অর্থবছরে ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে তিনগুণের বেশি ঋণ নিয়েছে। তারল্য কমে যাওয়ার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা কমে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দায় সরকারের রাজস্ব আয় কম হওয়ায় ও ব্যয় বাড়ায় নিতে হয়েছে বাড়তি ঋণ।

ফলে বাধ্য হয়েই সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাড়িয়ে ঋণ নিতে হয়েছে। এতে একদিকে টাকার প্রবাহ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। এসব টাকা উৎপাদনমুখী কাজে ব্যয় করা হলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা কিছুটা উপশম করতে পারে। কিন্তু যদি দৈনন্দিন কাজে ব্যয় হয় তবে তা আরও বেশি বিপজ্জনক। সরকার এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ চলতি ব্যয় নির্বাহে ব্যবহার করছে। যে কারণে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, সরকার গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিয়ে যেমন রেকর্ড করেছে। তেমনি গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৮১১ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেও রেকর্ড গড়েছে। অর্থাৎ ওই বছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। বরং আগের ঋণ পরিশোধ করেছে।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ মানেই হচ্ছে ছাপানো টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরজুড়েই টাকা ছাপানোর কাজটি করে। ছাপানো টাকা ভল্টে রাখা হয়। ভল্টে থাকা অবস্থায় একে বলে ‘জড়বস্তু বা নন লাইভ’ টাকা। বাজারে চাহিদা বাড়লে টাকা ছাড়ে। ছাপানো টাকা বাজারে এলেই একে বলা হয় ‘লাইভ বা জীবন্ত’। অর্থাৎ ভল্টে থাকলে মূল্যহীন কাগজ ও বাজারে এলে মূল্যমান মুদ্রা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ অর্থকে বলা হয় হাইপাওয়ার্ড মানি বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাকা। এগুলো বাজারে এসে টাকার প্রবাহ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, বাড়িয়ে দেয় জনভোগান্তি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের কোনো নিয়মনীতি নেই। তবে এ ঋণ নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ এতে জনভোগান্তি বাড়বে। তবে সরকার আর্থিক সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। এটি বিশ্বের সব দেশই করে। করোনার সময় মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমস তিন লাখ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছিল।

বর্তমানে বাজারে সরবরাহ করা মুদ্রা প্রায় ১৯ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোয়া তিন লাখ কোটি টাকা ছাপানো আকারে বাজারে আছে। বাকি অর্থ নোট নয়, তবে ইলেকট্রনিক বা প্লাস্টিক মানি আকারে আছে। নগদ নোট ছাড়া সব টাকাই ইলেকট্রনিক ফর্মে রয়েছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই আগস্টে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন কোনো ঋণ নেয়নি। বরং আগের কিছু ঋণ পরিশোধ করেছে। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে বাজারে ছাপানো টাকার প্রভাব কিছুটা কমেছে। বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পালে এখনো হওয়া লাগেনি। এ ছাড়াও সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ কমেছে। এদিকে বেসরকারি খাত অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনিশ্চয়তা ভুগছে। যে কারণে তারা ঋণ নিচ্ছে না। এ কারণে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেই এখন ঋণ নিচ্ছে।

গত বছরের জুনে ব্যাংকে তারল্য ছিল চার লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২১ হাজার কোটি টাকায়। এক বছরে তারল্য কমেছে ২১ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক মন্দায় সরকারের রাজস্ব আয় কম হয়েছে। এর বিপরীতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। বিশেষ করে মন্দার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করতে বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিতে হয়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বাড়াতে হয়েছে। এতে করে সরকারের খরচ বেড়েছে। ফলে বাড়তি ঋণ নিতে হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য কমে যাওয়ার কারণে সেখান থেকে ঋণ গ্রহণ কমাতে হয়েছে। গত অর্থবছরে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ২৫ হাজার কোটি। নন ব্যাংকিং খাত নিয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে এ খাত থেকে নিয়েছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে তিনগুণের বেশি। যা অতীতে কখনোই ঘটেনি।

২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছিল সাড়ে ১৭ শতাংশ। গত বছরে রাজস্ব আয় বেড়েছে সোয়া ১১ শতাংশ। অথচ ব্যয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ। ফলে ঘাটতি মেটাতে বেশি ঋণ নিয়েছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল তিন হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হজার ২৫৮ কোটি টাকা। ২০২১৯-২০ অর্থবছরে ঋণ কিছুটা বাড়িয়ে নিয়েছে ১০ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এ অর্থবছরের শেষ দিকে করোনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ বেড়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার কোনো নতুন ঋণ নেয়নি। বরং আগের ঋণ শোধ করেছে ১৯ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। একই বছরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার কমে যাওয়ায় ঋণ কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ বেড়ে ৩১ হাজার ৩০৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরে যা তিনগুণের বেশি বেড়ে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই আগস্টে আগের ঋণ কিছুটা শোধ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়েছে। আগস্টে এ হার আরও বেড়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে বেশি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor