জাতীয় নির্বাচনের ধাক্কা স্পষ্ট হচ্ছে, বৈদেশিক অর্থব্যয় কমার শঙ্কা
জুলাই-অক্টোবর কমেছে ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ * চার মাসে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি ৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ
জাতীয় নির্বাচনের ধাক্কায় বৈদেশিক অর্থের ব্যয় কমার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই সেই আলামত স্পষ্ট হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ধীরগতির কারণে গত চার মাসে কমেছে এ অংশের টাকার খরচ। জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত গত অর্থবছরের তুলনায় কম ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে চার মাস পেরিয়ে গেলেও এক টাকাও খরচ করতে পারেনি ছয়টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা। এসবের অনুকূলে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ৩-৪ মাস নির্বাচনকালীন মনিটরিংব্যবস্থা থাকবে নড়বড়ে। ফলে গতি হারাবে উন্নয়ন কাজ। রাজনৈতিক সহিংসতাসহ নানা কারণে এ সময়টাতে স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ফলে বৈদেশিক অর্থের ব্যয় কমবে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এর আগে বলেছিলেন, নির্বাচনের ধাক্কা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে লাগবে না। কেননা নির্বাচন হচ্ছে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে আমরা যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব, তারাই ব্যস্ত থাকব। এদিকে যারা প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত, তারা তো আর নির্বাচন করবে না। কাজেই তারা তাদের কাজ করবে। ফলে নির্বাচনের কারণে বৈদেশিক অর্থব্যয় কমার কোনো কারণ নেই। এমনিতেই কমলে সেটি ভিন্ন কথা।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী শনিবার বলেন, নির্বাচনি ডামাডোল শুরু হচ্ছে। এ সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কমাটাই স্বাভাবিক। অতীতেও দেখা গেছে, নির্বাচনি বছরে এমন ঘটনা ঘটেছিল। চলতি বছর বৈদেশিক অর্থের ব্যবহার আরও বেশি কমার শঙ্কা রয়েছে। কেননা সহিংস ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে প্রকল্পের গতি কমবে, এটা বলা যায়। এ অবস্থায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ নজরদারি বাড়াতে হবে।
বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ আছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চার মাসে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ১৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা, যা ওই বছরের মোট বরাদ্দের ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ হিসাবে তুলনামূলক কম খরচ হয়েছে ১ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এছাড়া মাসিক ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায়, শুধু অক্টোবরে ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের অক্টোবরে ব্যয় হয়েছিল ৫ হাজার ৩৩৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বা ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, নির্বাচনি অর্থবছরের এই সময়টাতে সবাই নির্বাচন নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। এ সময় মনিটরিং ঠিকমতো থাকবে না। উন্নয়নসহযোগীসহ অনেক পক্ষই অপেক্ষা করবে কী হয় দেখার জন্য। সেই সঙ্গে এবার নির্বাচন ঘিরে নানা ঘটনার আশঙ্কা আছে। পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে, সেটি নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমাটা স্বাভাবিক।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের চার মাস পেরিয়ে গেছে, অথচ এক টাকাও খরচ করতে পারেনি ছয়টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থ। এগুলোর মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ আছে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অনুকূলে ১৯১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ১৬১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের ১১ কোটি ২৭ লাখ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ আছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এগুলো ব্যয়শূন্য। এছাড়া এখনো ৫ শতাংশের নিচে বৈদেশিক অর্থ খরচ রয়েছে সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলোর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ব্যয় করেছে বরাদ্দের শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ৩ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ ব্যয় করেছে। আরও আছে কৃষি মন্ত্রণালয় ৪ শতাংশ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যয় করেছে মোট বরাদ্দের ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্থ।
আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন শনিবার বলেন, হঠাৎ করেই কেন বৈদেশিক অর্থের ব্যবহার কমল, সেটি নিয়ে আমি মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এটা কাভার হয়ে যাবে। আর জাতীয় নির্বাচন হলেও কর্মকর্তারা কিন্তু বসে থাকবেন না। বরং বন্ধের দিনও তারা মাঠে যাচ্ছেন প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য। এছাড়া এ সময়টায় অর্থ বরাদ্দ ঠিকই থাকবে। পাশাপাশি নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়া আর হচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এ মুহূর্তে তো কিছু বলা যায় না। তবে প্রকল্প মনিটরিং যাতে সর্বোচ্চ থাকে, সে বিষয়ে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।