International

জাপানে জনসংখ্যা কমা ঠেকাতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

জাপানকে জনসংখ্যা নিয়ে দ্বিমুখী সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রথমত, জনসংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, প্রবীণ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া। এই পরিস্থিতিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছে। এমনই এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতোও-চু।

চলতি বছরের শুরুতে প্রকাশিত সরকারি তথ্য অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ কোটি। আগের বছরের চেয়ে যা প্রায় ৮ লাখ কম। ২০০৮ সাল থেকে জাপানের জনসংখ্যা প্রতিবছর কমছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অবশ্যই সন্তান জন্ম দেওয়ার হার কমে যাওয়া, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফার্টিলিটি রেট’। কোনো একটি দেশের জনসংখ্যা ধরে রাখতে হলে এই হার ২ দশমিক ১ রাখা জরুরি। কিন্তু জাপানে তা ১ দশমিক ৩। ফলে জনসংখ্যায় ধস নামা ঠেকানোয় মনোযোগ দিতে হচ্ছে জাপানকে। তাই জাপান সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে দেশের তরুণ নাগরিকদের সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করতে। পাশাপাশি সমস্যার গভীরতা আঁচ করতে পেরে দেশের বেসরকারি খাতও বেশ কিছুদিন থেকে এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেছে।

জাপানের জাতীয় পর্যায়ের উপাত্তে দেখা যায় দেশের জনসংখ্যার ২৯ দশমিক ১ শতাংশের বয়স এখন হচ্ছে ৬৫ বছর কিংবা বেশি। জাপানের জনসংখ্যা ও সামাজিক নিরাপত্তা ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত এক হিসাবে দেখা যায়, ২০৪০ সালে এই হার হবে ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবীণদের এই হার অর্থনীতির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। প্রবীণদের পেনশন ও চিকিৎসা খরচের ভর্তুকি দিতে ব্যয়ের বিশাল এক বোঝা সরকারের ওপর পড়ছে। ফলে সেদিক থেকেও সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা জাপান সরকারকে করতে হচ্ছে।

জাপানের বাণিজ্যিক সংস্কৃতিকে খুবই কঠোর হিসেবে দেখা হয়। এখানে কর্মীদের সার্বক্ষণিক দায়িত্বপালনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে তরুণদের কাজের বাইরে অন্য কিছুতে জড়িত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সংসার জীবনের ওপরও বিমুখ হচ্ছে তারা

শুরুতেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, জনসংখ্যা হ্রাস সমস্যার সমাধানে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন এবং বেসরকারি খাতের কোম্পানিও আজকাল নানারকম পদক্ষেপ নিচ্ছে। জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পেছনে যেসব কারণ জাপানে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার মধ্যে আছে ব্যয়বহুল জীবনযাত্রার পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কম সামাজিক সুবিধা। অন্যদিকে গড় মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও জাপান ইদানীং অন্যান্য অগ্রসর দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। ফলে তরুণ প্রজন্ম সংসারজীবন গড়ে নিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে এবং এর ফলে বিয়ের বয়সও পিছিয়ে যাচ্ছে।

জাপানের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ কোটি। আগের বছরের চেয়ে যা প্রায় ৮ লাখ কম। ২০০৮ সাল থেকে জাপানের জনসংখ্যা প্রতিবছর কমছে

জাপানের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ কোটি। আগের বছরের চেয়ে যা প্রায় ৮ লাখ কম। ২০০৮ সাল থেকে জাপানের জনসংখ্যা প্রতিবছর কমছেফাইল

পাশাপাশি পেশাগত কর্মজীবন শুরু হয়ে যাওয়ার পর কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততাও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে দেখা দেওয়া এক ধরনের ভীতি আজকাল বাড়িয়ে দিচ্ছে। জাপানে অনেকেই মনে করছেন, বিশেষ করে জন্মহার হ্রাস পাওয়ার সমস্যা সরকারের পক্ষে এককভাবে সমাধান করে নেওয়া সম্ভব নয়। বেসরকারি খাতেরও এই ক্ষেত্রে করণীয় অনেক কিছু আছে।

জাপানের বেসরকারি খাতের নেতৃস্থানীয় অনেক কোম্পানি অবশ্য সম্প্রতি নিজস্ব অবস্থান থেকে সমস্যার গভীরতা লাঘবে অবদান রাখা শুরু করেছে। জাপানের সে রকম নেতৃস্থানীয় একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি হচ্ছে ইতোও-চু।

জাপানে জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পেছনে যেসব কারণ জাপানে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার মধ্যে আছে ব্যয়বহুল জীবনযাত্রার পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কম সামাজিক সুবিধা।

১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি সূচনার দিনগুলো থেকেই সামাজিক দায়িত্ব পালন করাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আসছে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চুবেই ইতোও যে চেতনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন, তার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে তিন পক্ষের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসা। আর সেই তিন পক্ষ হচ্ছে বিক্রেতা, ক্রেতা এবং সমাজ। কোম্পানি এখনো সেই নীতি সমুন্নত রেখেছে এবং দেশের জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে সেই চেতনা এখন ভিন্ন কিছু দিক থেকে কার্যকর করার চেষ্টা করে চলেছে। ইতোও-চু বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেও ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং বাংলাদেশে যেসব জাপানি কোম্পানির সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, ইতোও-চু হচ্ছে তাদের অন্যতম, স্বাধীনতার ঠিক পরপর যারা তাদের বাংলাদেশ কার্যালয় চালু করেছিল।

জাপানের তরুণ প্রজন্ম সংসারজীবন গড়ে নিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। এর ফলে বিয়ের গড় বয়সও বেড়ে যাচ্ছে

জাপানের তরুণ প্রজন্ম সংসারজীবন গড়ে নিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। এর ফলে বিয়ের গড় বয়সও বেড়ে যাচ্ছে

জাপানের বাণিজ্যিক সংস্কৃতিকে খুবই কঠোর হিসেবে দেখা হয়। এখানে কর্মীদের সার্বক্ষণিক দায়িত্বপালনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে দেশের নেতৃস্থানীয় কোম্পানিগুলোতে পেশাজীবন শুরু করা তরুণদের কাজের বাইরে অন্য কিছুতে জড়িত হওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। এমনকি সাংসারিক জীবনের সঙ্গেও তাঁদের একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। বিবাহিত পারিবারিক জীবন গড়ে নেওয়া এবং সন্তান জন্ম দিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন তাঁরা।

ইতোও-চু এখন আগের সেই প্রচলিত ধারা থেকে বের হয়ে এসে তরুণদের সংসার ও জীবনের অন্যান্য দিক সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করার পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে, যার মধ্যে আছে শিশুসন্তান থাকা কর্মচারীদের জন্য অফিস চত্বরে শিশু পরিচর্যাকেন্দ্র চালু করা এবং সব কর্মচারীর জন্য অফিস ভবনেই বিনা মূল্যে সকালের খাবার সরবরাহ করা।

শিশু পরিচর্যাকেন্দ্র অফিসসংলগ্ন ভবনে থাকায় সন্তানকে দূরে কোথাও রেখে এসে অফিস করা নিয়ে মা–বাবাকে এখন আর দুশ্চিন্তায় ভুগতে হচ্ছে না। অফিস শেষ করে সন্তানকে নিয়ে তাঁরা বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন এবং সুবিধাজনক সময় অনুযায়ী কাজ করার সুযোগও তাঁরা পাচ্ছেন। অর্থাৎ নয়টা-পাঁচটার কঠোর সময়সূচি মেনে চলা এখন আর কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এর বদলে শিশুসন্তান থাকা কর্মচারীরা সকাল সাতটা কিংবা আটটায় কাজ শুরু করে শিশু পরিচর্যাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন। এর বাইরে সকালে বিনা মূল্যে অফিসে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া না করে অফিসে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও তাঁরা পাচ্ছেন।

সাংবাদিকদের কাছে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন জাপানের ইতোও-চু কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কোবাইয়াশি ফুমিহিকো

সাংবাদিকদের কাছে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন জাপানের ইতোও-চু কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কোবাইয়াশি ফুমিহিকো

টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের একটি দলের সদস্য হিসেবে জাপানের এই ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক কোম্পানির গ্রহণ করা ব্যতিক্রমী সেই উদ্যোগ দেখার সুযোগ হয়েছিল এই প্রতিবেদকের। সকালে অফিসে প্রাতরাশ সেরে নেওয়া কর্মীদের কয়েকজন বলেছেন, ঘুম থেকে উঠে বাড়িতে সকালের আহারের ব্যবস্থা না করে অফিসে চলে আসা সম্ভব হচ্ছে, ফলে কাজে মনোনিবেশ করতে পারার ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে পারিবারিক জীবন গড়ে নেওয়ার যে ভীতি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সেটা কাটিয়ে ওঠাও এর মধ্যে দিয়ে সম্ভব হবে বলে তাঁদের কয়েকজন মনে করেন।

অন্যদিকে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে রাখা বক্তব্যে ইতোও-চুর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কোবাইয়াশি ফুমিহিকো বলেছেন, কোম্পানির কার্যকর করা নতুন এ রকম সব ব্যবস্থা শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে নিতেও অবদান রাখছে। ফলে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার দেখে যাওয়া সাম্পো-ইয়োশির স্বপ্ন এর মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়িত হতে থাকায় কোম্পানির কর্মী, বাইরের ক্রেতা বা ব্যবসায়িক অংশীদার এবং সমাজ—সবাই এর থেকে উপকৃত হচ্ছেন।

ইতোও-চুর ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ অন্যরাও গ্রহণ করতে এগিয়ে আসে কি না, তা অবশ্য এখনো পরিষ্কার নয়। তবে জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে সামান্য হলেও কিছু অবদান এ কোম্পানি যে রাখতে পারছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor