জাপার ডাকে চুপ স্বতন্ত্ররা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১ আসনে জয়ী হয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার আইনগত ভিত্তি হারিয়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে ৬২ আসনে বিজয়ী হয়ে বিরোধী দলের আসনে বসার সুযোগ থাকলেও আগ্রহ নেই স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের (এমপি)। ফলে সংসদে বিরোধী দল কে হচ্ছে তা নিয়ে একধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। আর তাই স্বতন্ত্রদের নিজেদের সঙ্গে ভিড়িয়ে বিরোধী দলে বসতে চায় জাপা। কিন্তু তাতে সাড়া দিচ্ছেন না স্বতন্ত্র এমপিরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়, স্বতন্ত্র এমপি ও জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই জটিলতা দূর করতে সবার চোখ আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার দিকেই। তাদের সবার বক্তব্য, বিরোধী দলে কে বসবে তা ঠিক করতে শেখ হাসিনাকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
৭ জানুয়ারির ভোটে নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিরোধী দলের আসনে বসতে চান না। এ কারণেই বিরোধী দল নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন কীভাবে বণ্টন হবে, সেটাও ঠিক করা যাচ্ছে না।
স্বতন্ত্র এমপিরা বলেন, বিরোধী দলে কে বসবে সেই সিদ্ধান্ত সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে। তারা বলেন, ভোটের মাঠে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারালেও তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ। তাই নিজেরা আগ্রহী হয়ে জোট বা ফ্রন্ট গঠন করে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার কোনো উদ্যোগ স্বতন্ত্র এমপিরা নিজেরা নেবেন না। তারা সরকারি দলের আসনেই বসতে চান। জাপার চেষ্টায় দলটির সঙ্গে যেতে চান না তারা। তবে, সংসদ নেতা শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্দেশনা দিলে যেতে রাজি আছেন।
জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে, সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও সুযোগ ছাড়তে চায় না জাপা। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে টানতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাপার মধ্যমসারির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, দলটির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও এখনো সাড়া দেননি স্বতন্ত্র এমপিরা। তারা জাপাকে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত চান, তার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর দুই সদস্য বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গী করে জাপাকে বিরোধী দলের আসনে বসার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হলেও বিরোধী দলীয় নেতা, বিরোধী দলীয় উপনেতা, হুইপ এসব নিয়ে হিসাব রয়েছে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের। তাই এ বিষয়ে সমাধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দিতে হবে। তা না হলে বিরোধী দল নিয়ে সংকট দূর হবে না।
একাধিক স্বতন্ত্র এমপি বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার উৎসাহ ছিল বলেই তারা নির্বাচন করতে পেরেছেন। তা না হলে তাদের অনেকেই নির্বাচনে থাকতেন না। এখন তাদের চাওয়া সরকারি দলের চেয়ারে বসা। সেই সুযোগ না থাকলে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দেবেন, সেটাই তারা করবেন।
এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘সরকারি দলের পর জাতীয় পার্টি তো সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়নি। তারা কীভাবে বিরোধী দল হবে। এখন সংবিধান অনুযায়ী যারা বিরোধী দল হয় তারাই হবে। যেহেতু স্বতন্ত্ররা কোনো দল নয়, তারা একত্র হয়ে জোট বা ফ্রন্ট হতে হবে। স্বতন্ত্ররা একত্র হয়ে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তাহলে তাদেরই বিরোধী দল করা হবে।’
বরিশাল থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অভিভাবক। দেশ, গণতন্ত্র ও সরকার পরিচালনার স্বার্থে আমাদের মতো কর্মীদের তিনি যেখানে কাজে লাগাবেন, আমরা সেটাই করব।’
মাদারীপুর থেকে নির্বাচিত তাহমিনা বেগম বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) যদি আমাদের গ্রহণ করেন ভালো, না করলে ওই রকমই থাকব। আমি বিরোধী দলে যাব না। অবশ্য, আমার সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নেবেন।’
হবিগঞ্জ থেকে নির্বাচিত আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমি পারিবারিকভাবে জয় বাংলার মানুষ। শেখ হাসিনার কর্মী, বঙ্গবন্ধু আমার নেতা। এর বাইরে আমার কোনো পরিচয় নেই। নেত্রী যদি সুযোগ না দিতেন, আমি স্বতন্ত্র দাঁড়াতে পারতাম না।’
কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দায়িত্ব পাওয়ার পরে বলতে পারব।’
জানতে চাইলে স্বতন্ত্র এমপি ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বলেন, ‘নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ হয়নি। আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একেকজন একেক এলাকার। সংসদে যাই। সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগ নেতা ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, বিরোধী দল বলতে কিন্তু কোনো দলকে বোঝায় না। সংসদে প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা তাদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার জন্য প্রস্তাব হবে। আর অন্য যারা আছেন, তাদের ভেতর থেকে যদি কেউ প্রস্তাব করে যে আমরা এতগুলো সদস্য একত্র হয়েছি, আমাদের বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া হোক। তখন স্পিকার যাচাই করবেন তাদের সঙ্গে কতজন সংসদ সদস্য আছেন। যাচাইয়ে যদি দেখা যায়, তারা বিরোধী দল হওয়ার উপযুক্ত, তখন তাদের সেই মর্যাদা দেওয়া হবে। বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়ার পর তাদের স্পিকার বলবেন, আপনারা এখন বিরোধী দলের নেতা, উপনেতা, হুইপ ও চিপ হুইপের তালিকা দেন।
অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম বলেন, ‘হিসাবটা একদম এ রকম।’
এই আইনজীবী বলেন, জাতীয় পার্টিকে সামনে রেখে স্বতন্ত্র এমপিরা বিরোধী দল হতে চাইলে জাতীয় পার্টি হবে।