Bangladesh

ডলারের পর টাকার সংকট: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক মন্দায় তীব্র ডলার সংকটের মধ্যে এখন টাকার সংকটেও পড়েছে সরকার।

আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ব্যয় বেড়েছে। এর বিপরীতে আয় বাড়েনি, বরং কমেছে।

ব্যয়ের তুলনায় আয় না বাড়ায় টাকার সংকটে পড়েছে সরকার। করোনার সময় থেকে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার টাকার সংকটে পড়েছিল। ওই সময়ে রাজস্ব ঘাটতির টাকা সরকার ঋণ করে মিটিয়েছে। এখন রাজস্ব আয় ঘাটতির পাশাপাশি ঋণের সংকটও রয়েছে। ঋণ করার মতো যথেষ্ট টাকা ব্যাংকেও নেই। ফলে সরকারের টাকার সংকট বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনার আগে থেকেই অর্থনৈতিক মন্দা ছিল। ওই সময়েও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় হয়নি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ে। এ কারণে দীর্ঘ সময় লকডাউন ছিল।

সে সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। যে কারণে রাজস্ব আদায়ও কম হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এনবিআর বহির্ভূত খাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

এরপরে ২০২০-২১ অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছিল ৩ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।

গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছিল। ওই ঘাটতি মেটানো হয়েছিল ব্যয় সংকোচন ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে।

গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে দুই খাত মিলিয়ে আগের অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ কমেছে। ওই সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা।

রাজস্ব আয়ে ঘাটতি হলে ওই টাকা সরকার ঋণ করে মিটিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে সরকারের ঋণের দরজা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যে কারণে আগের মতো এবার আর ঋণ পাচ্ছে না। ফলে সরকারের টাকার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট ও আমানত প্রবাহ কমায় তারল্য সংকট বেড়েছে। এতে করে ব্যাংকগুলোর পক্ষে সরকারকে বড় অঙ্কের ঋণের জোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ সরকার ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ সংকট আরও বাড়বে।

এতে বেসরকারি খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ভেঙে পড়তে পারে। এ কারণে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেওয়াও সরকারের অন্যতম একটি উৎস। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। এ হার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ আগে নিলেও এখন আর নিতে পারছে না। এতে সুদের হার বেশি এবং আইএমএফ এ খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমাতে বলেছে। এসব মিলে সব খাত থেকেই সরকারের ঋণের দুয়ার সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বন্ড মার্কেট থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও এটি এখনও বিকশিত হয়নি।

এ মার্কেটে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর এখনও অংশগ্রহণ বাড়েনি। এছাড়া সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে এ খাতেও সুদের হার বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে এ খাতে একটি টাকার সংকট ও অন্যদিকে চড়া সুদ। এ দুইয়ে মিলে এ খাত থেকেও ঋণের জোগান কম। ফলে রাজস্ব ঘাটতির টাকা ঋণ করে মেটানো যাচ্ছে না।

একই সঙ্গে বৈদেশিক উৎস থেকেও ঋণ যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে অনুদান। ফলে বৈদেশিক খাতে অর্থের প্রবাহ কমে গেছে। এতে টাকার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে সরকার ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বৈদেশিক অর্থের প্রয়োজন হয় এমন সব প্রকল্পের কাজ কমিয়ে দিয়েছে। এখন ঋণের সংকটে অনেক প্রকল্পের কাজও কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সরকার ডলারের পাশাপাশি টাকা খরচেও ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে রেকর্ড পরিমাণে ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে এ খাতে বিক্রি কমানো হয়। একই সঙ্গে পণ্যমূল্য বাড়ার কারণে মানুষের বিনিয়োগের সক্ষমতাও কমে যায়। ফলে ওই বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ কমে দাঁড়ায় ২০ হাজার কোটি টাকা।

আইএমএফের শর্তের কারণে গত অর্থবছর থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আরও কমাতে হয়। ফলে গত অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার নতুন নিট ঋণ নিতে পারেনি। উলটো অন্য খাত থেকে ঋণ নিয়ে সঞ্চয়পত্রের দেনা শোধ করেছে।

আগে সঞ্চয়পত্র বিক্রির অর্থ থেকে গ্রাহকদের আগের দেনা পরিশোধ করে আরও অর্থ উদ্বৃত্ত থাকত। সেগুলো সরকারের নতুন ঋণ হিসাবে যোগ হতো। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হওয়ায় গত অর্থবছরে এ খাত থেকে নতুন কোনো ঋণ গ্রহণ না করে বরং আগের ঋণ পরিশোধ করেছে ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে পরিশোধ করেছে ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি। গত অর্থবছরের ওই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ৩১০৭ কোটি টাকা। অন্য খাত থেকে ঋণ করে এ খাতের আগের দায় শোধ করা হচ্ছে।

গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন ঋণ না নিয়ে আগের নেওয়া ঋণ থেকে ৩৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছরের ওই সময়ে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়েছিল ১৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আগের ঋণের স্থিতি থেকে ১৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে নিয়েছিল ১১ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আগের ঋণের স্থিতি থেকে পরিশোধ করেছে ২৪ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। নন ব্যাংক খাত থেকে গত অর্থবছরের ওই সময়ে নিয়েছিল ২৫ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে নিয়েছে ৬১৪৮ কোটি টাকা। বৈদেশিক খাত থেকে গত অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে ঋণ নিয়েছিল ১৭ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে ওই সময়ে নিয়েছে ১২ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। দেশীয় ও বৈদেশিক খাত মিলিয়ে গত অর্থবছরের নিট অর্থায়ন হয়েছিল ৩১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে ঘাটতি হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের জুলাই নভেম্বরে অনুদান কমেছিল ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ৪০ শতাংশ।

এদিকে ডলার সংকটের কারণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ ব্যাহত হচ্ছে। একই কারণে সরকারি খাতের আমদানিও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। রেমিট্যান্স বাবদ যেসব বৈদেশিক মুদ্রা আসছে তার একটি বড় অংশই ব্যয় করা হচ্ছে সরকারি খাতের আবশ্যিক পণ্য আমদানিতে। এর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেল, গ্যাস, উন্নয়ন প্রকল্পের কাঁচামাল।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor