Bangladesh

তিন কিশোরের দুঃসহ কারাবাস যন্ত্রণা

রায়হান, তৌহিদুল, পারভেজ– তিন কিশোর। এ বয়সেই কারাভোগের নির্মম অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের। তবে ‘শিশু-কিশোর’ হিসেবে নয়, থাকতে হয়েছে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ ব্যক্তি হিসেবে তাদের সঙ্গেই। দেশে শিশু অধিকার সুরক্ষা আইন থাকলেও তা প্রয়োগ হয়নি এ কিশোরদের ক্ষেত্রে। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে টানা সরকারবিরোধী আন্দোলনে এই তিন কিশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মী সন্দেহে আরও অনেক শিশু-কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের অনেককেই শিশু আইনে সোপর্দ না করে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। একে আইনের ব্যত্যয় ও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষ্য, বয়স নির্ধারণে গ্রেপ্তারদের কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকায় তাদের নিয়মিত আইন অনুযায়ী সোপর্দ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, সারাদেশে গণহারে গ্রেপ্তারের ঘটনায় কোনো আইনকানুনেরই তোয়াক্কা করা হয়নি। শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী অনূর্ধ্ব-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি ‘শিশু’ হিসেবে গণ্য হবে। সেখানে কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলে আইন অনুযায়ী শিশু আদালতে বিচারকাজ পরিচালনা করার নিয়ম রয়েছে। শিশু আইনে বলা হয়েছে, অপরাধ সংঘটনের তারিখই হবে শিশুর বয়স নির্ধারণের জন্য প্রাসঙ্গিক তারিখ।

এমন ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর পল্লবী থানায়। গত বছরের ১৯ নভেম্বর মিরপুর ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সাড়ে ১৪ বছর বয়সী মাজেদুল ইসলাম রায়হান ও ১৬ বছর বয়সী তৌহিদুল ইসলামকে। ওই দু’জনের সঙ্গেই কথা বলেছে সমকাল। এর মধ্যে মাজেদুল ইসলাম রায়হান এতিম। জন্মের পর বাবা-মাকে দেখেনি। সে জানে না নিজের পরিচয়। পায়নি পরিবারের আদর-যত্ন আর ভালোবাসা। তাতে কী? নিজের কল্পনা জগতেই সে তৈরি করে নেয় বাবা-মা আর ভাইবোন। সেখানে বাবাকে রাগী হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে তাকে মৃত দেখানো হয়েছে।

 সে নিজেই বাবার নাম দিয়েছে আলমগীর হোসেন। আর মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। রয়েছে বড় এক ভাই ও এক বোন। মনে মনে সে তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে, কখনও রাগ করে। আর সেই রাগ-অভিমান থেকেই সে বেরিয়ে আসে বাসা থেকে। এভাবেই নিজের একটি আলাদা জগৎ তৈরি করে সে। সঙ্গে আলাপে সে নিজের সম্পর্কে এমনটিই জানায়। বাবা-মা নেই, মানুষের নানা তির্যক প্রশ্নের জবাব না দিতেই তার এই বানানো জগৎ। 

কিন্তু সেখানেও ধাক্কা খেতে হয়েছে রায়হানকে। এক গ্রেপ্তার অভিযানে ভেঙে পড়ে তার গড়া ভিন্ন ভুবন। কিশোর হয়েও তাকে প্রাপ্তবয়স্ক আইনে কারাগারে থাকতে হয়েছে প্রায় দুই মাস। বিএনপির সক্রিয় কর্মী সন্দেহে পল্লবী থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে কেরানীগঞ্জ কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। যেখানে আইনের পুরো ব্যত্যয় ঘটেছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। শিশু আইনে আদালতে সোপর্দ না করে রায়হানকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক উল্লেখ করে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় ব্যাহত হয়েছে এ শিশুর আইনি সুরক্ষার অধিকার। শুধু মাজেদুল ইসলাম রায়হান নয়, তার মতো তৌহিদুল ইসলাম, পারভেজ, জুবায়েরের মতো আরও অনেককে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির আন্দোলনের সময়ে। তাদের কেউই শিশু সুরক্ষা আইনে প্রতিকার পায়নি। 
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান সমকালকে বলেন, এখানে শিশু-কিশোর আইন লঙ্ঘন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। দেশে মানবিকতা না থাকলে, আইনের শাসন না থাকলে– এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আর এটাও একটা জঘন্য অপরাধ। 

কিশোর মাজেদুল ইসলাম রায়হানের কাছ থেকেই জানা গেল, মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার সরকারি শিশু পরিবারে বড় হয়েছে সে। এক পর্যায়ে ওই সংস্থা থেকেই তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় পাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই তথ্য যাচাইয়ে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার ‘সরকারি শিশু পরিবার’-এ গিয়ে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। ওই সময়ের উপতত্ত্বাবধায়ক এসএম মিজানুর রহমান তাকে ভর্তি করেন। শিশু পরিবারের রেজিস্টারে বাবা-মায়ের নামের স্থানে ‘অজ্ঞাত’ উল্লেখ রয়েছে। তার সঙ্গে আসা চিঠিতে সম্ভাব্য জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৯ সালের ৩০ জুলাই।

শিশু পরিবারের একজন কর্মকর্তা জানান, যেসব শিশুকে হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়, তাদের ‘বেবি সেফ হোম’-এ নিয়ে আসা হয়। বয়স ৬ বছরে স্বাভাবিক নিয়মে বদলি করা হয় সরকারি শিশু পরিবারে। সেই নিয়মানুযায়ী মাজেদুল ইসলাম রায়হানকেও টঙ্গী থেকে বদলি করা হয় ঢাকার মিরপুর ১০-এর সরকারি শিশু পরিবারে। সেখানে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হলেও পড়ালেখা তার ভালো লাগেনি। সেখান থেকে পালিয়ে এসে পথশিশুর কাতারে নাম লেখায়। দয়াবশত একজন তাকে ভাতের  হোটেলে কাজ জুটিয়ে দেয়। সেই থেকে সে মিরপুর সাড়ে ১১ এলাকার ফুটপাতে একটি ভাতের হোটেলে কাজ করত। 

রায়হান জানায়, যেদিন পুলিশ গ্রেপ্তার করে সেদিন কাজ শেষে এলাকার বন্ধুদের নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আড্ডা দিচ্ছিল। সেখানে পুলিশ এসে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তার বন্ধু তৌহিদুল ইসলামসহ তাকে গ্রেপ্তার করে পল্লবী থানায় নিয়ে যায়। রাতটা থানায় থেকে সকালে আদালতে তোলা হয়। সেখান থেকে সোজা কেরানীগঞ্জ কারাগারে। মামলার কাগজে তার বয়স দেখানো হয়েছে ১৮ বছর।

কোনো ‘আপনজন’ না থাকায় কারাগারে বসে চিন্তায় পড়ে রায়হান। কীভাবে বের হবে, কে মামলা চালাবেন তা নিয়ে শঙ্কা বাড়তে থাকে। সেখানে পরিচয় হয় মোহাম্মদপুর থানা যুবদল নেতা লিটন মিয়ার সঙ্গে। ২৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্তির পর লিটন কথা বলেন মোহাম্মদপুর থানা বিএনপি নেতা ও আইনজীবী মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন সাকিফের সঙ্গে। তিনিও মানবিক কারণে রায়হানের জামিনে মুক্তির জন্য উদ্যোগী হন। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে রায়হান। 

আইনজীবী সারোয়ার হোসেন সাকিফ জানান, রায়হানের বয়স নিয়ে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেটা সম্ভব হলে এবং শিশু আদালতে গেলে রায়হান এই দুঃসহ জীবন থেকে অল্পতে মুক্তি পাবে। এখন তাকে হাজিরা দিতে নিয়মিত আদালতে যেতে হয়।

রায়হানের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া তৌহিদুল ইসলামের বাবা ইব্রাহিম সেলিম জানান, তাঁর ছেলের জন্ম ২০০৭  সালের নভেম্বরে। অভাব-অনটনের সংসারে লেখাপড়া হয়নি। একটু বড় হওয়ার পরপরই গার্মেন্টে কাজে দেওয়া হয়। গ্রেপ্তারের এক মাস পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ জানতে পারেননি। বিভিন্ন স্থানে ছেলেকে খুঁজলেও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে জানতে পারেন তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এরপর এক আইনজীবী ধরে গত ১০ জানুয়ারি জামিনে মুক্ত করান ছেলেকে। কোনো রাজনীতি করে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পেটনীতি করেই তারা দিশা করতে পারেন না। সেখানে রাজনীতি করেন কীভাবে? 
এই দু’জনের বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্লবী থানার উপপরিদর্শক তারিক উর রহমান শুভ বলেন, অনেক দিন আগের ঘটনা। তাই সবকিছু মনে করতে পারছি না। 

গত ২২ নভেম্বর বিএনপির সক্রিয় কর্মী হিসেবে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করা হয় রায়েরবাজারের কাঁচাবাজার এলাকা থেকে পারভেজ নামের একজনকে। তাকে পরে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়। সেখানে পারভেজের বয়স দেখানো হয়েছে ২১ বছর। অথচ পারভেজের বড় ভাই আসাদ জানান, তার  ভাইয়ের প্রকৃত বয়স ১৭ বছরের কম। অভাব-অনটনে তাদের পরিবারের কেউই লেখাপড়া করতে পারেনি। ছোটভাই পারভেজ বাজারের একটি মুরগির দোকানে কাজ করে। বয়স কম হওয়ায় তার ভোটার আইডি কার্ডও করা হয়নি। তাদের পরিবারের কেউই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। এর পরও তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা  বলতে পারছেন না। এখন প্রত্যেক মাসে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। মামলা চালানোর সামর্থ্যও তাদের নেই। 

এ তিনজনের বাইরে এখনও কারাগারে আছে জুবায়ের নামের এক কিশোর। আইনজীবী মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন সাকিফ জানান, কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতা আনোয়ার তাকে জানিয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীর নামে করা এক মামলায় বন্দি রয়েছে জুবায়ের নামের একজন। তার কেউ নেই। নিয়োগ করতে পারেনি কোনো আইনজীবী। তার ওই তথ্যের ভিত্তিতে তিনি জুবায়েরের মুক্তির জন্য আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। 

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, এটা অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। আইনেরও ব্যতয় ঘটেছে। হয়তো আদালতের বিচারক কিশোরদের স্বচক্ষে না দেখেই কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। এমনটা হয়ে থাকলে মোটেই সঠিক কাজ করেননি আদালত। এভাবেই আমাদের সমাজে অবিচার চলছে। 
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, কারো বয়স বাড়িয়ে ভুলভাবে আদালতে উপস্থাপন সঠিক কাজ নয়। এখন দেখতে হবে কোন পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাদের কারাগারে পাঠালো। শিশু হিসেবে যদি আদালতে উপস্থাপন না করা হয় এবং ধারণা করা হয় সে সাবালক, তাহলে বিচার শেষ হয়নি। এরপর তদন্ত হবে যে সে সাবালক না নাবালক। এতে বেরিয়ে আসবে যে তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। 

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তার বয়স কম দেখানোর সুযোগ নেই। সার্টিফিকেটে যে বয়স থাকে সেটাই দেখানো হয়। এরপরও যদি বয়স কম হয়, তাহলে আদালত তাকে শিশু আইনে বিচার করবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button