তিন বছরে দ্বিগুণ হয়েছে বাজার-ভিত্তিক ঋণ, বাড়ছে পরিশোধের চাপ
দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অর্থায়নের অন্যতম প্রধান উৎস বিদেশি উৎসের ঋণ। কিন্তু, এগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে ভাসমান বা বাজার-ভিত্তিক সুদহারের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকায় ঋণ পরিশোধ বাংলাদেশের জন্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অর্থায়নের অন্যতম প্রধান উৎস বিদেশি উৎসের ঋণ। কিন্তু, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাজার-ভিত্তিক (বা ভাসমান) সুদহারের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকায় এসব দেনা পরিশোধ বাংলাদেশের জন্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রবণতার ফলে কেবল ঋণের সুদ পরিশোধই নয়, বরং আসল পরিশোধের ক্ষেত্রেও বাড়তি চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। কারণ, বাজার-ভিত্তিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড স্বল্পমেয়াদি হয়, পরিশোধের মেয়াদও হয় তেমন, যথাক্রমে – ৩ ও ১২ বছর; সে তুলনায়, স্থির সুদহারের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ও পরিশোধের মেয়াদ সাধারণত হয় যথাক্রমে ৫ ও ২০ বছর।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বাজার-ভিত্তিক ঋণ পরিশোধের চাপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাওয়া মোট ৮.৪৬ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে ২৮ শতাংশই ছিল এ ধরনের ঋণ। আগের বছরের ২৩.৬ শতাংশের চেয়ে যা অনেকটাই বেড়েছে, এবং মাত্র তিনবছর আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথমসারির উন্নয়ন সহযোগী– এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জন্য ১.৮৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দেয়। এর পাঁচ ভাগের চার ভাগের ক্ষেত্রে বাজার-ভিত্তিক সুদহার কার্যকর হবে, এতে সুদহার হবে ৫ থেকে ৭ শতাংশের মতোন।
দেশের সুদ পরিশোধের প্রক্ষেপণে ইতোমধ্যেই এ পরিবর্তনের আঁচ স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো (বিদেশি ঋণের) সুদ পরিশোধ ১ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত দেড় বছর ধরে স্থানীয় মুদ্রা টাকার যে অবমূল্যায়ন ঘটছে, উচ্চ পরিশোধ ব্যয়ের পেছনে সেটিও ভূমিকা রাখছে।
বাজার-ভিত্তিক সুদহারের ঋণ উদ্বেগের বিষয় কেন
উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে স্থির সুদহার ও বাজার-ভিত্তিক সুদহার দুই ধরনের ঋণই নেয় বাংলাদেশ।
স্থির সুদহার পদ্ধতিতে, ঋণচুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সুদহার পরিশোধ করতে হয়। এই সুদহারের কোন পরিবর্তন হয় না।
অপরদিকে, বাজার–ভিত্তিক সুদহারের ঋণে বাংলাদেশকে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট সোফর এবং ইউরো ইন্টারব্যাংক অফারড রেট (ইউরিবোর) হারে সুদ দিতে হয়।
মাত্র দুবছর আগেও বাজার-ভিত্তিক ঋণ নিয়ে তেমন চিন্তার কোন কারণ ছিল না, যখন সোফর হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তারপর থেকে সোফর সুদহার অনেকটাই বেড়ে গেছে। গত ১৪ অক্টোবর নাগাদ যা ছিল ৫.৩১ শতাংশ।
এছাড়া, বর্তমাণে সোফর রেট এর সঙ্গে স্প্রেড যোগ করে বিদেশি ঋণের জন্য বাংলাদেশকে সুদ দিতে হয়। এতে সুদহার শেষপর্যন্ত দাঁড়ায় ৬ থেকে ৭ শতাংশে।
একই ঘটনা, ইউরিবোর-ভিত্তিক ঋণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ইআরডির হালানাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সুদ পরিশোধ ৬৮.৫ শতাংশ বেড়েছে ।
ইআরডি প্রক্ষেপণ করেছে, চলতি অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সুদ পরিশোধ ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। প্রক্ষেপণ অনুসারে, চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের ১.১৯ বিলিয়ন ডলার সুদ বাবদ দিতে হবে বাংলাদেশকে।
সে তুলনায়, গত অর্থবছরে ৯৩৭ মিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করে বাংলাদেশ, তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪৯১ মিলিয়ন ডলার।
গবেষণা সংস্থা- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আগে বিশ্বব্যাংক, এডিবির আগে থেকে আমরা ফিক্সড রেটে (স্থির সুদহারে) ঋণ পেতাম। কিন্তু, এখন এটা ক্রমান্বয়ে কমছে। ফলে আমাদের ফ্লোটিং রেটের লোন নিতে হচ্ছে। ফ্লোটিং রেট বা বাজার-ভিত্তিক সুদহারের ঋণের কারণে শুধু মাত্র সুদ পরিশোধের চাপ বাড়বে না। একইসঙ্গে আসল পরিশোধেও চাপ বাড়বে। কারণ বাজার-ভিত্তিক সুদহারের ঋণ পরিশোধের সময় কম থাকে।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এই অবস্থায় বাজার-ভিত্তিক সুদহারের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে সতর্ক হতে হবে। যেসব প্রকল্পে রিটার্ন আসবে না, সেসব প্রকল্প না নেওয়ায়ই ভালো। কারণ এ ধরনের প্রকল্প আমাদের ঋণের দায় বাড়বে। ‘যেমন বৈদেশিক ঋণে পদ্মা রেল সংযোগের মতো প্রকল্প না নেওয়াই ভালো হবে। এ রুট লাভজনক করতে হলে প্রতিদিন ২৮ কোটি টাকা আয় করতে হবে সরকারকে, যা একেবারেই অসম্ভব।’
গত অর্থবছরের পরিস্থিতি
গত অর্থবছরে, বাংলাদেশ এডিবির থেকে ১.৮৫৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, এরমধ্যে ৭৭.৪৪ শতাংশ হলো বাজার-ভিত্তিক। এডিবির থেকে নেওয়া বাজার-ভিত্তিক ঋণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
এছাড়া, বহুপাক্ষিক দাতাসংস্থাটি বাংলাদেশকে ২ শতাংশ স্থির সুদহারেও ঋণ দেয়। কিন্তু, পর্যায়ক্রমে এ ধরনের ঋণ কমছে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-র থেকে নেওয়া সব ঋণই বাজার-ভিত্তিক।
উচ্চ সোফর রেটের কারণে, গত অর্থবছরে এআইআইবির থেকে কোন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ নেয়নি বাংলাদেশ। সে বছর শুধু রিজার্ভ শক্তিশালী করতে বাজেট সহায়তা হিসেবে তাদের থেকে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় সরকার। তবে এই বাজেট সহায়তাও উচ্চ সোফর সুদহারেই নিতে হয়েছে।
বাংলাদেশ এখন নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)-র থেকে ঋণ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চীনের সাংহাই ভিত্তিক এ সংস্থার থেকে প্রতিবছর ১ থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ, যার শতভাগই হবে বাজার-ভিত্তিক সুদহারের।
এপর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৭ প্রকল্পে ২.৫৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে বাজার-ভিত্তিক সুদহারে। তবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের থেকে বাজার-ভিত্তিক কোনো ঋণ নেয়নি।
বিশ্ববাংক বাংলাদেশকে শূন্য সুদহার থেকে শুরু করে বাজার-ভিত্তিক সুদে ঋণ দিচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ঋণদাতাটির থেকে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল, যা একক বছরের হিসাবে সর্বোচ্চ। ১.২৫ শতাংশ সুদ এবং শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জের শর্তে এ ঋণ পেয়েছে।
কিন্তু, চলতি অর্থবছর এবং আগামী অর্থবছরে ৯০০ মিলিয়ন করে মোট ১.৮ বিলিয়ন বাজার-ভিত্তিক ঋণের প্রস্তাব রয়েছে।
স্থির সুদহার ও বাজার-ভিত্তিক ঋণের প্রক্ষেপণ
ইআরডি ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩.৬ শতাংশ থেকে – ২০৪১ সাল নাগাদ, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে বাজার-ভিত্তিক ঋণের পরিমাণ ৮২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
ইআরডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বাংলাদেশের বাজার-ভিত্তিক ঋণ হবে ৪২.৪ শতাংশ এবং সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০৩১ সালে বাংলাদেশ যখন উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে তখন এর অংশ পৌঁছাবে ৫৫.৭ শতাংশে।
২০৪১ সালে বৈদেশিক ঋণের ৮২ শতাংশ হবে বাজার-ভিত্তিক এবং মোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৪.২ শতাংশ হবে রেয়াতি ঋণ। ২০২০ সালে রেয়াতি ঋণ ছিল ৫৯.৪ শতাংশ।
ইআরডির প্রতিবেদনমতে, আনুষ্ঠানিক দাতাদের থেকে পাওয়া আর্থিক সহায়তার মধ্যে রেয়াতি অংশ কমে যাওয়ার ফলে ঋণ পরিশোধের খরচও বাড়বে।
অবশ্য আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ বাড়বে। এছাড়া, বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ ঘটলে– সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের জন্যই বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
২০২৬ সালে দেশের উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে, এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যও নিয়েছে সরকার।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের রেয়াতি সুবিধা) ও অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্সেস (এডিবি-র রেয়াতি সুবিধা) এর পাশাপাশি অ-রেয়াতি ঋণ সুবিধার মিশ্র অর্থায়নের দিকে ঝুঁকেছে।
ইআরডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির পর, আগামী বছরগুলোতে অন্যান্য বহুপাক্ষিক উন্নয়ন অংশীদাররাও বাংলাদেশের জন্য পর্যায়ক্রমে তাদের রেয়াতি ঋণ ছাড় কমাবে।
আনুষ্ঠানিক ঋণ সহায়তাকে উন্নয়ন প্রকল্প অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ণ উৎস বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।