Bangladesh

তৃণমূল বিএনপি সাজাচ্ছে আ.লীগ!

সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা মাঠের বিরোধী দল বিএনপি থেকে নজর ঘুরিয়ে তৃণমূল বিএনপিকে ‘বড়’ করার দিকে মনোযোগ দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে ‘ছোট’ করে এ কাজটি করতে চায় সরকারি দল।

আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃণমূল বিএনপিকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। তারা চান, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে বিদেশিদের যে চাপ রয়েছে, সেটা সামাল দিতে তৃণমূল বিএনপি হবে ঢাল।

বিএনপি ছেড়ে আসা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। তার মৃত্যুর পর দলের হাল ধরেন তার মেয়ে অন্তরা হুদা। চলতি বছর দলটির নেতৃত্বে এসেছেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকার। তাদের সঙ্গে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজেরও যোগ দেওয়ার গুঞ্জন ছিল।

গত সোমবার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ ঢাকায় দলের এক সমাবেশে বলেছেন, অনেকেই লাইন ধরে আছেন তৃণমূলে (তৃণমূল বিএনপি) যোগ দেওয়ার জন্য।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন নেতৃত্ব আর উদ্যম নিয়ে আসা তৃণমূলকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় এবং আলোচনায় আনা যায় সেদিকেই আওয়ামী লীগ দৃষ্টি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বিএনপির অবরোধ শেষে অসহযোগ কর্মসূচি দিতে পারে, এমন আভাস ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তবে দলটির আন্দোলন মোকাবিলায় আপাতত নতুন কোনো পরিকল্পনা নেই আওয়ামী লীগের। বিএনপি নেতাদের গ্রেপ্তার অভিযানের মধ্য দিয়ে বিএনপিকে দমন করা সম্ভব হবে বলে মনে করে আশ্বস্ত রয়েছে ক্ষমতাসীনরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলনকে কখনই আমলে নিইনি আমরা। তাদের কর্মসূচিও শিগগিরই হারিয়ে যাবে।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলন নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে আর কোনো আগ্রহ নেই। আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনী মুডে কাজ করছে। একটি সুন্দর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে যে কাজগুলো করার প্রয়োজন, আওয়ামী লীগ তা করছে।’ ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেন, তৃণমূল বিএনপির দিকে নজর দিয়েছেন তারা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির ওপর ভর করার সিদ্ধান্ত থাকায় এই দলটিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী সাজানোর কাজে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। অন্তরালে থেকে এ কাজগুলো করতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। প্রথমত নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় তৃণমূল বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চায় ক্ষমতাসীনরা। দ্বিতীয়ত যাদের এই দলের নেতৃত্বে দেখতে চায় আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ার কাজ শুরু করেছে দলটি।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবরের পরে বিএনপি এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে বলে আওয়ামী লীগ মনে করছে।

ওই নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ মনে করছে, মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছেও এখন আবেদনহারা বিএনপি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএনপিকে ছেঁটে ছোট করে তৃণমূল বিএনপিকে শক্তিশালী করে তুলতে সচেষ্ট সরকারি দল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করবেন বলে দেশ-বিদেশে অঙ্গীকার করেছেন। বিদেশিদের চাপ রয়েছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও। এটা নিশ্চিত করতেই তৃণমূল বিএনপিকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন মনে করছে ক্ষমতাসীনরা।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে তৃণমূল বিএনপিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবছে ক্ষমতাসীনরা। বিএনপি ছেড়ে আসা নেতারা তৃণমূল বিএনপির হয়ে নির্বাচন করলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিদেশি দাবি মেটাতে পারবে আওয়ামী লীগ। এজন্য আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা হচ্ছে, আগে মূল বিএনপিকে ছোট করতে হবে। আর মাঠের বড় এই বিরোধী দলটিকে ছোট করতে হলে বিএনপি থেকে নির্ভরযোগ্য নেতাদের বের করে আনতে হবে। পাশাপাশি তৃণমূল বিএনপিতে তাদের জায়গা দিয়ে বড় করে তুলতে হবে সংগঠনটিকে।

আওয়ামী লীগের বিশ্বাসযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী সংসদে সদস্য হতে আগ্রহী বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের তিন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, তৃণমূল বিএনপিতে আসতে রাজি বিএনপির এমন অনেক নেতাই আছেন। এই দলে যোগ দিলে মনোনয়ন পাবেনই এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন এমন কী গ্যারান্টি আছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চান তারা। আওয়ামী লীগের পক্ষে যারা বিএনপির ওই নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তারা দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

এ তিন নেতা বলেন, আলোচনা এখন যে পর্যায়ে রয়েছে তফসিল ঘোষণার পর সেটি প্রকাশ্যে রূপ নেবে। তৃণমূল বিএনপি অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তারা বলেন, যাদের পেতে চাই, তারা এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেননি। আবার যারা আসলেও যা, না আসলেও তা তাদের ব্যাপারে তৃণমূল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের তেমন আগ্রহ নেই। সে কারণে তৃণমূল বিএনপি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তা বলা যাচ্ছে না।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তৃণমূল বিএনপিকে লক্ষ্য অনুযায়ী শক্তিশালী করে নির্বাচনে আনার মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে বিদেশিদের দাবি পূরণ করা যাবে। এ ছাড়া বিএনপির গ্রহণযোগ্য নেতাদের তৃণমূল বিএনপিতে আনার মাধ্যমে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিও বাড়ানো সম্ভব হবে বলে তারা মনে করছেন।

সরকারি দলের এই নেতা বলেন, বিএনপি মূলত যেসব নেতার ওপর নির্ভর করে বর্তমানে রাজনীতি করছে, তৃণমূল বিএনপির মূল লক্ষ্য হলো তাদের দলে ভেড়ানো। আর তাদের সংসদ সদস্য করে আনার দায়িত্ব নেওয়া হবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, তারা বিশ্বাস করেন যে, বিএনপির প্রবীণ অনেক নেতাই জীবনের শেষবেলায় এসে সংসদ সদস্য হতে চান। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে ওই দলের বড় একটি অংশ শুধু সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য তৃণমূল বিএনপিতে আসতে চান। তিনি বলেন, বর্তমানে বিএনপিকে নেতৃত্ব দেওয়া তারেক রহমানের ওপর ক্ষুব্ধ একটি অংশও দল ছাড়তে চায়। এ দুই অংশ মিলে বড় একটি অংশ হয়ে যাবে তৃণমূল বিএনপিতে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নানা দল মিলিয়ে ১২০ আসনও ছেড়ে দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন তারা। সব ঠিক থাকলে উল্লেখযোগ্য আসন তৃণমূল বিএনপি পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাছাড়া, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর জন্যও বড়সংখ্যক আসন ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে আওয়ামী লীগের। বিএনপি নির্বাচনে আসবে না সেটা ধরে নিয়েই এ পরিকল্পনা। আবার দলটি নির্বাচনে আসুক, সেটাও চায় না ক্ষমতাসীনরা।

জানতে চাইলে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘বিএনপির শুধু নেতারাই নন, কর্মীরাও চান নির্বাচনে আসুক বিএনপি। এ চাওয়ার মূল্যায়ন না হলে নেতারা তো কোনো না কোনো ছাতায় যাবেনই।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কারও জন্য থেমে থাকবে না, কোনো আন্দোলনও আটকাতে পারবে না।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button