Bangladesh

দামে অস্থিরতা, মিষ্টি চিনি এখন ‘তেতো’

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতায় পুড়ছে চিনিও। অস্বাভাবিক দামের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে মিষ্টি চিনি এখন অনেকটাই ‘তেতো’। এক বছরে সরকার নির্ধারিত সাদা চিনির দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। আর গত কয়েক দিনে প্রতি কেজি চিনির দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ৪০ টাকা।

এমনকি সরকারি চিনিও নির্ধারিত দামের চেয়ে অন্তত ৪০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তাদের সুবিধার্থে চিনিতে শুল্ক কমানো হলেও দামের ঊর্ধ্বগতি থামানো যাচ্ছে না।

দেশে প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীন চিনিকল থেকে উৎপাদিত মাত্র ২১ হাজার ৩১৩ টন, যা সরাসরি আখ থেকে উৎপাদন করা হয় এবং বাজারে লাল চিনি হিসেবে পরিচিত।

এই চিনি চাহিদার তুলনায় দেড় শতাংশেরও কম। ফলে চিনির বাজারের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আর সে কারণেই ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে ভোক্তারা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চিনি আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক অর্ধেক কমিয়েছে।

অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক তিন হাজার টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার ৫০০ টাকা করেছে। আর পরিশোধিত চিনির শুল্ক ছয় হাজার টাকা থেকে কমিয়ে তিন হাজার করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের বাইরে থেকে অপরিশোধিত চিনি নিয়ে এলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক ও ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। তবে এক কেজি চিনি ভোক্তার হাতে যাওয়া পর্যন্ত মোট ৬০ শতাংশের বেশি কর আরোপ করে সরকার, যা ৪০-৪২ টাকা। এসব মিলিয়েই সরকার প্রতি কেজি খোলা চিনির মূল্য নির্ধারণ করেছিল ১৩০ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকা কেজি।

তবে সরকার শুল্ক কমালেও তার কোনো প্রভাব বাজারে দেখা যায়নি।

কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে চিনি

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার চারটি দোকানে গত শনিবার খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, খোলা চিনি প্রতি কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনি কোনো দোকানেই নেই। স্বদেশ বাজার নামের একটি মুদি দোকানের বিক্রেতা জানালেন, তাঁর দোকানে শুধু লাল (সরকার উৎপাদিত) চিনি আছে। দাম প্রতি কেজি ১৬০ টাকা। বাজারে সাদা চিনি নেই বলেও তিনি দাবি করেন।

একই সড়কের মুদি দোকানি সোহেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খোলা চিনি ১৫০ টাকা কেজি। প্যাকেট চিনি নেই, কোথাও পাচ্ছি না। আমি এক বস্তা খোলা চিনি নিয়ে এসেছি। আমার কাছ থেকে ৯০০ টাকা বেশি রেখেছে। আগে ছিল ছয় হাজার ২০০ টাকা বস্তা, আজকে নিয়েছে সাত হাজার ১০০ টাকা।’

বাজারে সরবরাহ কম

রাজধানীর ভাটারা এলাকার ছায়েদ আলী সুপারমার্কেটের পাঁচটি মুদি দোকানে খোঁজ নিয়ে মাত্র একটি দোকানে সাদা প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যায়। এ ছাড়া কোনো দোকানেই খোলা চিনি পাওয়া যায়নি, ছিল লাল চিনি। একজন দোকানি বলেন, ‘অন্য কোনো চিনি নেই। আছে শুধু লাল চিনি। তাও ১৭৫ টাকা কেজি।’ একই মার্কেটের মায়া স্টোরের বিক্রেতা লাল চিনি বিক্রি করছেন ১৭৫ টাকা কেজি দামে। আর খোলা চিনি ১৫০ টাকা।

সরকারি চিনির দাম কত

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চিনি উৎপাদন করে, যা ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রি করে। এই প্রতিষ্ঠান সাধারণত প্যাকেটজাত ও বস্তায় খোলা চিনি বিক্রি করে। তারা বস্তার খোলা চিনি সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রির অনুমতি দেয় এবং খোলা চিনি প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা যাবে না। অর্থাৎ বস্তার খোলা চিনি ওই অবস্থায়ই বিক্রি করতে হবে। এখন ১৩৫ টাকার খোলা চিনি প্যাকেটজাত করে মাশিরা বিডি লিমিটেড সরবরাহ করছে ১৬২ টাকা কেজি দরে, যা বাজারে এখন ১৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এভাবে বিক্রি করা বৈধ নয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।

ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠান ক্যাবের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার মাধ্যমে দাম বেঁধে দেয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের যখন সুবিধা হয় তখন সরকারের কথা মানে, আর সুবিধা না হলে মানে না। এটা হলো বাস্তবতা। সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না করে দাম বেঁধে দিলে সে দাম কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমদানি করা কম্পানিগুলোর বাজারের ওপরে বজ্র আঁটুনি আছে। এরা বাজারকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, নতুন কোনো কম্পানি চিনি আমদানি করে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে কি না সন্দেহ। তবে সরকার টিসিবির মাধ্যমে প্রভাব ফেলতে পারে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও ডলারের উচ্চ মূল্য চিনির বাজারে প্রভাব ফেলছে। গত বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘শুল্ক কমানো হয়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি কারণে চিনির দাম বৃদ্ধি কম্পানিগুলোর একটা অজুহাত। কারণ ডলারের যে বাড়তি দাম, এই দামে কেনা চিনি বাজারে আসতে দুই মাস লাগবে। এখন তারা এই সুযোগটা নিচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম যেটা ঠিক করে দিয়েছিল, সেটা কখনই বাজারে কার্যকর হয়নি।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button