Bangladesh

দুর্বলতার কারণে অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান দিতে ব্যর্থ ব্যাংক

দুর্বলতার কারণে অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে ব্যাংক খাত। ডলার সংকটের পাশাপাশি টাকার সংকটও বাড়ছে ব্যাংকগুলোতে। ফলে অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণের জোগান দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন খাতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি খাত ঋণ না নিলেও ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছে ২৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ দশমিক ৩০ গুণ কম। একই সময়ে নন-ব্যাংক খাত থেকে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছে ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২ গুণ কম। নন ব্যাংক খাতের ঋণ নিয়েছে সঞ্চয়পত্র, ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে। মোট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়েছে ৩৬ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৪ দশমিক ৩০ গুণ কম।

চলতি অর্থবছরের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কম। জুন পর্যন্ত এ খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১১ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত বেড়েছে ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪ শতাংশ কম।

সরকার ও বেসরকারি খাত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঋণ কম নিলেও ব্যাংক খাত এখন টাকার সংকটে ভুগছে। তারল্য সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান দিতে পারছে না। 

এদিকে উদ্যোক্তারাও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় ডলারের সংকট, ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে নতুন ঋণ নিতে চাচ্ছেন না। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এতে যেমন উৎপাদন কমে যাচ্ছে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানের গতিও থমকে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোতে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। মার্চে তা সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ৩ মাসে তারল্য বেড়েছে মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহের চেয়ে ঋণ বিতরণ করেছে বেশি। এছাড়া বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে পারছে না। খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর প্রভিশন খাতে অর্থ আটকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ ও মূলধন থেকে আয় কমে গেছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার প্রবাহ কমেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ব্যাংক খাত দুর্বল হয়ে পড়ায় অর্থনীতিতে চাহিদা অনুযায়ী ডলার ও টাকার জোগান দিতে পারছে না। রিজার্ভ যখন বেশি ছিল তখন একে নিয়ে সরকার নানা খেলা খেলেছে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে, ঋণ দিয়েছে। কিন্তু রিজার্ভ হচ্ছে বিপদে ব্যবহার করার জন্য। যখন বিপদ এলো তখন এত রিজার্ভ দিয়ে ৩ মাসও টেকা গেল না। রিজার্ভে টানাটানি শুরু হলো। যা এখনো চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যাংক খাতের বিষয়ে শক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় আর ছাড় দেওয়া মোটেও উচিত হবে না। কিন্তু তারপরও দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার স্বাধীন সত্তা হারিয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন অর্থনীতিতে চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান দিতে পারছে না। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চে ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবাহ বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। একই সময়ে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো গড়ে আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। অথচ ব্যাংকগুলো আমানতের পুরোটা ঋণ হিসাবে বিতরণ করতে পারে না। প্রচলিত ব্যাংকগুলো মোট আমানতের ৮৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। বাকি ১৭ শতাংশ বিধিবদ্ধ আমানত হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের সাড়ে ৯ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। বাকি সাড়ে ৮৯ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো গড়ে বিনিয়োগ করেছে ৭৮ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল থাকার কথা। তারপরও অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ আমানত রাখতে পারছে না। এ জন্য প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ কলমানি মার্কেট ও এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে।

ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেশি হারে টাকা জমা রাখে। কারণ বিপদে পড়লে এসব অর্থ এনে চাহিদা মেটাতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক জমা অর্থের পরিমাণ কমে গেছে। ২০২২ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকায়। মার্চে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার কোটি টাকায়। তবে বিধিবদ্ধ আমানত হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জমা রাখার কথা ২ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। জমা রয়েছে ৪ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। চাহিদার চেয়ে বেশি, জমা রয়েছে। ওইসব অর্থের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষ তারল্য সহায়তা নিয়ে থাকে।

খেলাপি ঋণ ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি বড় অংশ আটকে রয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ছিল ১ লাখ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। ২ বছর ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ের ব্যবধানে প্রভিশন সংরক্ষণ ৬৬ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৮১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। করোনার আগে থেকেই ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দিয়ে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনার সময় তা আরও বেড়েছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে গত বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ছাড় ছিল। ফলে এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় বাড়েনি। ফলে নগদ আয় কমে গেছে।

এছাড়া ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বাণিজ্য করতে পারছে না। ফলে এ খাতের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া আমদানি ব্যয় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে গিয়ে নগদ টাকা আটকে যাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছিল ৭৬০ কোটি ডলার। ওই সময়ে ডলারের গড় দাম ছিল ৯২ টাকা। এ হিসাবে ব্যাংক থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি করেছে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলার। ওই সময়ে গড়ে ডলারের দাম ছিল ১০৭ টাকা। এ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিক্রি করেছে ১ হাজার ১৭০ কোটি ডলার। ওই সময়ে ডলারের গড় দাম ছিল ১১০ টাকা। এ হিসাবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা। এ কারণে ব্যাংকে তারল্য সংকট বেড়েছে। তবে এসব টাকার একটি অংশ বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে জোগান দেওয়া হচ্ছে।

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। ফলে ঋণের সুদহার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এ কারণেও ঋণের প্রবাহ কমেছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে টাকার প্রবাহও কমাচ্ছে। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়েছিল ৭১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই সময়ে টাকার প্রবাহ কমেছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এসব বহুবিদ কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বেড়েছে। এ সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতাও কমে গেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor