Bangladesh

দেশে নারীপ্রধান পরিবার বাড়ছে

সর্মি রায়ের (৩৫) বাবা মারা যান ২০১০ সালে। এরপর সংসার চালাতে তিনি গ্রাফিক ডিজাইনারের চাকরি নেন। দুই বছর আগে চাকরি ছেড়ে ‘অহনা রন্ধনশালা’ নামে রান্না করা খাবার বিক্রির উদ্যোগ নেন। মধ্য বাড্ডায় মা-মেয়ের সংসার এখন চলে তাঁর উপার্জনে। বড় দুই বোনের আলাদা সংসার।

সর্মি বলেন, জন্ম থেকে তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। স্বজনেরাও কখনো তাঁকে গুরুত্ব দিতেন না। উপার্জন শুরুর পর এখন তিনিই সংসারের সব সিদ্ধান্ত নেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, পাঁচ বছরে অবিবাহিত নারীদের মধ্যে পরিবারপ্রধান হওয়ার হার বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ।

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কাঁকন আক্তার (২৮) মাকে নিয়ে গ্রামে থাকেন। দুই ভাই প্রবাসী। কাঁকন বলেন, বাজার করা, মাকে চিকিৎসক দেখানো, স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা—সব ক্ষেত্রে তিনি সিদ্ধান্ত নেন। ৩০ কর্মী নিয়ে ‘ভিলেজ ফুড উইথ সায়মা’ নামে নকশিকাঁথা ও নারকেলের নাড়ু তৈরির উদ্যোগ রয়েছে তাঁর।

পরিবারে মূল ভূমিকায় থাকা এই দুই নারীই অবিবাহিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, পাঁচ বছরে অবিবাহিত নারীদের মধ্যে পরিবারপ্রধান হওয়ার হার বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। বিবাহিত নারীদের মধ্যে এই হার বেড়েছে সামান্য। আর বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীদের মধ্যে বরাবরের মতো এই হার উচ্চ।

গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২’ প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবারপ্রধান হিসেবে অবিবাহিত নারীর হার প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই হার ছিল প্রায় ৩ শতাংশ।

গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২’ প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবারপ্রধান হিসেবে অবিবাহিত নারীর হার প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই হার ছিল প্রায় ৩ শতাংশ।

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খানাপ্রধান হওয়ার জন্য উপার্জনকারী বা বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য হতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, অনেক পরিবারের পুরুষ বিদেশে আছেন। সে ধরনের কোনো কোনো পরিবারে প্রধান হচ্ছেন নারী। এ ছাড়া পরিবারে দায়িত্ব পালনের মতো সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণেও পরিবারপ্রধান নারীর সংখ্যা বাড়ছে।

অনেক পরিবারের পুরুষ বিদেশে আছেন। সে ধরনের কোনো কোনো পরিবারে প্রধান হচ্ছেন নারী। এ ছাড়া পরিবারে দায়িত্ব পালনের মতো সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণেও পরিবারপ্রধান নারীর সংখ্যা বাড়ছে।

মো. আলমগীর হোসেন, বিবিএসের এসভিআরএস ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক

বিবিএসের প্রতিবেদন ও কিছু কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নেই বা পুরুষ দেশের বাইরে থাকেন, সেসব পরিবারে অবিবাহিত, বিবাহিত, বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীদের প্রধান হওয়ার হার বেশি।

এ ছাড়া কোনো পরিবারে পুরুষ থাকলেও অসুস্থতা, আলস্য, প্রতিবন্ধিতা বা অন্য কোনো কারণে উপার্জন করেন না—সে পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তি হিসেবে নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকায় থাকেন। এর বাইরে পরিবারে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থার কারণেও নারী পরিবারপ্রধান হন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীতে সম্পদের অধিকারের কারণে নারীরা পরিবারপ্রধান হচ্ছেন।

পরিবারে পুরুষ সদস্য থাকা সত্ত্বেও কাজ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও যোগ্যতার কারণে নারী পরিবারপ্রধান হলে সেটাকে প্রকৃত ক্ষমতায়ন বলা যাবে। একজন দরিদ্র নারী পরিবারপ্রধান হলেও ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থার মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সুবিধা করতে পারেন না।

সায়মা হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক

বিবাহিত নারী পরিবারপ্রধান

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে, বিবাহিত নারীদের মধ্যেও পরিবারপ্রধান হওয়ার হার গত পাঁচ বছরে সামান্য বেড়েছে। ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৭ শতাংশের বেশি, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশের বেশি।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বেলগাছি গ্রামের মোসাম্মৎ আমেনা খাতুন (২৮) বলেন, পাঁচ মাস আগে তাঁর স্বামী হাফিজুল ইসলাম সৌদি আরব গেছেন। এখনো টাকা পাঠাতে পারেননি। তিন শিশুসন্তানের পড়ালেখা, খাওয়া–দাওয়া, সংসার চালানোর ভার এখন তাঁর ওপর। সুতার মবিন করার মেশিন কিনেছেন। দিনে ৭৫ থেকে ১২০ টাকা আয় হয়। সেই টাকায় বাজার করেন।

বিবিএসের প্রতিবেদন ও কিছু কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নেই বা পুরুষ দেশের বাইরে থাকেন, সেসব পরিবারে অবিবাহিত, বিবাহিত, বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীদের প্রধান হওয়ার হার বেশি।

তবে পরিবারের মূল উপার্জনকারী হলেও দারিদ্র্যের কারণে তাঁর সিদ্ধান্ত সব সময় বাস্তবায়িত হয় না বলে আক্ষেপ করলেন রাজধানীর কুড়িল এলাকার শ্রমজীবী নারী মিলন (৪০)। তিনি গৃহকর্মীর কাজ করেন। মিলন প্রথম আলোকে বলেন, অসুস্থ স্বামী তিন সন্তান নিয়ে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে গ্রামের বাড়ি থাকেন। সংসারের সব খরচ দেন তিনি। তারপরও দুই সন্তানের পড়া বন্ধ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, পরিবারে পুরুষ সদস্য থাকা সত্ত্বেও কাজ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও যোগ্যতার কারণে নারী পরিবারপ্রধান হলে সেটাকে প্রকৃত ক্ষমতায়ন বলা যাবে। একজন দরিদ্র নারী পরিবারপ্রধান হলেও ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থার মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সুবিধা করতে পারেন না।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে, বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীদের মধ্যে পরিবারপ্রধানের হার সবচেয়ে বেশি। এই হার ৭৭ শতাংশের বেশি।

বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ নারী পরিবারপ্রধানের উচ্চ হার

২০২২ সালে স্বামী মাকসুদুল হাসানের আকস্মিক মৃত্যুর পর সংসার চালাতে মারিয়া আক্তার (৩১) সক্রিয় হন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ঢাকা ছেড়ে ফরিদপুর সদরে নিজেদের বাড়িতে থাকেন। ‘পিওর পার্ক বিডি’ নামে তাঁর একটি উদ্যোগ আছে। দুই সন্তানের সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, পারিবারিক কলহ থেকে স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তাঁর ১৬ বছর বয়সী একমাত্র সন্তান ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। মা-মেয়ের সংসারে তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

সম্পদের বিচারে নারী প্রধান হওয়ার হার ২০২৩ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালে ছিল ১৭, ২০২১ সালে ১৬, ২০২০ সালে ১৫, ২০১৯ সালে প্রায় ১৫ এবং ২০১৮ সালে ১৪ শতাংশ।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে, বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীদের মধ্যে পরিবারপ্রধানের হার সবচেয়ে বেশি। এই হার ৭৭ শতাংশের বেশি। আর বিপত্নীক ও বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া পুরুষের মধ্যে পরিবারপ্রধান হওয়ার হার প্রায় ২৩ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় তা বেশি।

সম্পদের বিচারে নারী প্রধান হওয়ার হার ২০২৩ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এর আগে ২০২২ সালে ছিল ১৭, ২০২১ সালে ১৬, ২০২০ সালে ১৫, ২০১৯ সালে প্রায় ১৫ এবং ২০১৮ সালে ১৪ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের একটি অংশ হচ্ছে, পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর গুরুত্ব আছে কিনা। পরিবারে একজন নারী স্বাবলম্বী হলে পরিবারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন বেশি হয়। এ ছাড়া নারীর মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা থাকায় পারিবারিক যেকোনো দুর্যোগে নারী বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button