Bangladesh

নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে আগ্রহ নেই, গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাচ্ছে

উত্তোলনযোগ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে আসছে। দেশীয় কোম্পানির অধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর পাশাপাশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান শেভরনের মজুতও ধীরে ধীরে কমে আসছে। ফলে দেশের গ্যাস খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের পরামর্শ দিলেও সরকার সেদিকে হাটছে না। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ২৯ দশমিক ৯২৬৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ২০ দশমিক ৩৫৩৪ টিসিএফ (মোট মজুতের ৬৮ শতাংশ)। ওই সময় দেশে অবশিষ্ট গ্যাস মজুত ছিল মাত্র ৯ দশমিক ৫৭৩১ টিসিএফ (৩২ শতাংশ)।

বাংলাদেশের মাটির নিচে গ্রাসসহ প্রচুর প্রাকৃতির সম্পদ রয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোও নিশ্চিত করেছে যে দেশে ব্যাপক পরিমাণ গ্যাসের সম্ভাবনা রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে জ্বালানির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তার যথাযথ ব্যবহারের চেস্টা করা হচ্ছে না। গ্যাস নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে, তারা সবসময়ই বলে আসছে গ্যাস আবিষ্কারের জন্য বঙ্গোপসাগর একটি উৎকৃষ্ট জায়গা। কিন্তু আমাদের দেশে অনুসন্ধানের হার খুবই নিম্নগামী। অনুসন্ধানে কার্যকর উদ্যোন নেয়া হচ্ছে না।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা ইতোমধ্যে কার্যকর করা হচ্ছে। এতে করে প্রায় ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হবে। সিলেট, ভোলা, বিয়ানীবাজারের কূপগুলো থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। পরিকল্পনার আওতায় সামনে গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। এ কোম্পানির অধীনে ছয়টি গ্যাসক্ষেত্রে মজুত ছিল ১২ দশমিক ২৫২০ টিসিএফ গ্যাস। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৯ দশমিক ২৫০২ টিসিএফ বা ৭৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। অবশিষ্ট রয়েছে তিন টিসিএফের কিছুটা বেশি গ্যাস।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানির অধীন পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রে মজুত ছিল ৭ দশমিক ৩৩ টিসিএফ। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র এক দশমিক ৮৫৫৯ টিসিএফ (২৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। অবশিষ্ট রয়েছে ৫ দশমিক ১৭৭১ টিসিএফ গ্যাস।

হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে সর্বোচ্চ গ্যাস মজুত রয়েছে রশিদপুর, তিতাস ও কৈলাসটিলায়। এ তিন ক্ষেত্রে গ্যাস মজুতের পরিমাণ যথাক্রমে ২ দশমিক ৪৩১৫ টিসিএফ, ২ দশমিক ২৫৬৭ টিসিএফ ও ২ দশমিক ০৮৩৯ টিসিএফ। এর মধ্যে তিতাস বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডসের অধীনে এবং রশিদপুর ও কৈলাসটিলা সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের অধীনে রয়েছে। এ তিনটি ক্ষেত্রের বাইরে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডসের অধীন বাখরাবাদে শূন্য দশমিক ৫১৫১ টিসিএফ, সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের অধীন ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৪৪৮২ টিসিএফ গ্যাস রয়েছে এবং বাপেক্সের অধীন সেমুতাং গ্যাস ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৩০৩৭ টিসিএফ গ্যাস মজুত রয়েছে।

জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৫ দশমিক ৬১৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭৮৩ দশমিক ১০৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ গত অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন কমেছে এক হাজার ১৩৭ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ঘনমিটার (৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ)।

বর্তমানে বাপেক্সের অধীনে গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে ৮টি। এগুলোতে গ্যাস মজুত ছিল এক দশমিক ৪৬০৮ টিসিএফ, যার মধ্যে শূন্য দশমিক ৬০৬৬ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। অবশিষ্ট রয়েছে শূন্য দশমিক ৯০০২ টিসিএফ।
পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৫ দশমিক ৬১৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭৮৩ দশমিক ১০৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ গত অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন কমেছে এক হাজার ১৩৭ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ঘনমিটার বা চার দশমিক ৭৮ শতাংশ।

বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন। কোম্পানিটির অধীন তিনটি ক্ষেত্রে গ্যাস মজুত ছিল ৭ দশমিক ৬১২৭ টিসিএফ। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৫৪২৩ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। অর্থাৎ শেভরনের অধীন ক্ষেত্রগুলো থেকে ৯৯ শতাংশের বেশি গ্যাস মজুত শেষ। বর্তমানে কোম্পানিটির অধীন জালালাবাদ ক্ষেত্রে কোনো গ্যাস মজুত নেই। মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানায় সামান্য গ্যাস মজুত রয়েছে। স্থানীয় সরবরাহের তুলনায় গ্রিডে বাড়তি গ্যাস দেয়ার ফলে শেভরনের মজুত দিনদিন কমে আসছে। গ্যাস সরবরাহ বর্তমান মাত্রায় অব্যাহত থাকলে আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে শেভরনের মজুত শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা ইতোমধ্যে কার্যকর করা হচ্ছে। এতে প্রায় ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হবে। সিলেট, ভোলা, বিয়ানীবাজারের কূপগুলো থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। পরিকল্পনার আওতায় সামনে গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে।

স্থানীয় কোম্পানির পরিচালনাধীন গ্যাসক্ষেত্রসমূহে মোট মজুত আছে অর্ধেকেরও বেশি। কিন্তু সে তুলনায় তারা গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহের মাত্রা বাড়াতে পারেনি। শেভরনের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে ঘাটতি পূরণের জন্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আদৌ প্রস্তুত কি না, সে নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, দেশের জ্বালানি খাতের যে সংকট, তার বিকল্পে আমরা কখনোই নজর দিই না। বিকল্পটা হলো, নিজ দেশের সম্পদের দিকে নজর দেয়া। নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে শেভরনের সরবরাহ কমে আসবে। সেক্ষেত্রে যদি আমাদের স্থানীয় সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নজর দেয়া না হয় তাহলে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়বে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button