Bangladesh

নামে উন্নয়ন কাজে টর্চারকেন্দ্র

আইনের সঙ্গে সংঘাতে (অভিযুক্ত ও রায়ের পর আটকাদেশ) ও সংস্পর্শে (ভুক্তভোগী, সাক্ষী) আসা শিশু, কিশোর, কিশোরীদের রাখা হয় শিশু উন্নয়নকেন্দ্রে। সংশোধন ও অপরাধপ্রবণতা থেকে দূরে রাখতে তাদের জন্য এ ব্যবস্থা। কিন্তু উন্নয়নকেন্দ্রে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় অনেকেই। উন্নয়নকেন্দ্র থেকে ফেরা শিশুদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে নানা অভিযোগ।

তারা বলছে, শিশু উন্নয়নকেন্দ্রে ‘গ্যাং’, ‘ক্যাপ্টেন’, ‘র‌্যাগিং’, ‘সিনিয়র’ কালচার তো আছেই, নানা ছুতোয় বড় ভাইয়েরা (দীর্ঘ সময় আটকাদেশে থাকা) শিশু ও কিশোরদের চড়-থাপ্পড়, কান ধরে ওঠবস করানো থেকে শুরু করে অভিনব সব শাস্তি দেয় শিশুদের। এর মধ্যে ‘মুরগি বানানো’ (উবু করে বসিয়ে মেঝে পর্যন্ত মাথা নিচু করে কানে ধরানো) এবং কাপড়, বাসন, মেঝে, বাথরুম ও দেয়াল পরিষ্কার করানো হয়।

দেশে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি শিশু উন্নয়নকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে একটি (বালিকা) ও টঙ্গীতে একটি (বালক) এবং যশোরে পুলেরহাটে একটি (বালক)। কেন্দ্রগুলোতে থাকা শিশুদের বলা হয় নিবাসী। উন্নয়নকেন্দ্রের এমন পরিবেশে আইনের সঙ্গে সংঘাতে আসা শিশুর সংশোধন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে মানবাধিকার ও শিশু অধিকারকর্মীদের।

৯ নভেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯-এ (শিশু আদালত) বিচারাধীন একটি মামলায় অভিযোগপত্র গঠনের দিনে হাজিরা দিতে আসে দুই কিশোর (১৭)। সাভারের বিরুলিয়া কাকব এলাকায় গত বছরের ৩০ মার্চ একটি ডাকাতি মামলায় স্থানীয় এক কিশোরকে ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর আদালতের মাধ্যমে আটকের পর পাঠানো হয় টঙ্গী শিশু উন্নয়নকেন্দ্রে। এই কিশোর ২ মাস ৮ দিন ছিল সেখানে। চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সে জামিন পায়। একই ঘটনায় আরেক কিশোরকে আটকের পর চলতি বছরের ২০ মার্চে হেফাজতে নেয় পুলিশ। প্রায় এক মাস উন্নয়নকেন্দ্রে থাকা এ কিশোর জামিন পায় গত ১৬ এপ্রিল। এই কিশোর জানায়, তার বাবা অটোরিকশাচালক। মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন।

ঘটনার সময় দুই কিশোর স্থানীয় এলাকায় একটি স্টিল মিল ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত বলে জানায় তারা।

দুই কিশোরের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানায়, উন্নয়নকেন্দ্রে প্রথম দিন যাওয়ার পর সেখানে তাদের ‘পাবলিক’ বলে ডাকা শুরু করে সবাই। তারা জানতে পারে প্রথম সেখানে কেউ গেলে তাকে এ নামে ডাকার রেওয়াজ। একেকটি কক্ষে রাখা হয় ৫ থেকে ১৫ শিশু-কিশোরকে। যারা আটকাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে উন্নয়নকেন্দ্রে আছে তারাই মূলত বড় ভাই বা সিনিয়র। কক্ষগুলোতে তাদের কথাই চূড়ান্ত। একেকটি ফ্লোরের সব কক্ষের দায়িত্বে থাকে একজন ‘হাউজ ক্যাপ্টেন’। বড়দের নির্দেশনামতো কক্ষে বা কেন্দ্রের যেকোনো জায়গায় মাথা নিচু করে হাঁটতে হয়। সিনিয়রদের চোখে চোখ রেখে, হাত বা আঙুল উঁচিয়ে কথা বলা যাবে না। হাসা যাবে না। কথা বলতে হবে নিচু গলায়। বড় ভাই বা ক্যাপ্টেন যখন ডাকবে সঙ্গে সঙ্গে সামনে আসতে হবে। তিন বেলা খাবারের পর যার যার বাসন নিজেই পরিষ্কার করতে হয়। ঊর্ধ্বতন ও নিরাপত্তাকর্মীরা এ ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করেন। কেউ কেউ তাদের উসকানি দেন।

তারা আরও বলে, কক্ষে বা অন্য কোথাও খালি গায়ে থাকা যাবে না। হাফপ্যান্ট পরা যাবে না। বড়রা নিজেদের মধ্যে গল্প, আলাপ করতে পারলেও ছোটরা সেটা করতে পারবে না। বাবা, মা কিংবা স্বজনরা সাক্ষাতের সময় খাবার নিয়ে গেলে বড় ভাইদের না দিয়ে তা খাওয়া যাবে না। বড়দের কাছে যদি এমন মনে হয়, কোনো শিশু বেশি বেয়াদবি করেছে, তাহলে ‘অ্যাভারেজ পার্টি’র শাস্তি দেওয়া হয়। এর অর্থ শাস্তিস্বরূপ এক দিন ওই শিশু পুরো ফ্লোরের প্রতিটি কক্ষের থালাবাসন মেজে পরিষ্কার করবে। এ ছাড়া শাস্তি হিসেবে শিশুটিকে নির্দিষ্ট সময় উবু হয়ে বসে মেঝে পর্যন্ত মাথা নুইয়ে এবং কান ধরে থাকতে হয়। এই শাস্তিকে উন্নয়নকেন্দ্রে বলা হয় ‘মুরগি বানানো’। তারা আরও বলে, কেন্দ্রের ভেতরে যেসব শিশু বাথরুম পরিষ্কার করবে তাদের ‘বাথরুম পার্টি’, যে মেঝে পরিষ্কার করবে তাকে ‘ফ্লোর পার্টি’, যে দেয়াল পরিষ্কার করবে তাকে ‘ওয়াল পার্টি’ ও কক্ষের লোহার গ্রিল পরিষ্কার করলে তাকে ‘গ্রিল পার্টি’ নামে ডাকা হয়। পালাক্রমে শিশুদের এ কাজ করতে হয়।

এক কিশোর বলে, বড় ভাইয়ের নির্দেশ মানতে একটু দেরি হওয়ায় তাকে ৩০ বার কান ধরে ওঠবস করতে হয়েছিল।

৫ নভেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর সামনে কথা হয় মায়ের সঙ্গে আসা এক কিশোরের সঙ্গে। ২০২২ সালের ১৮ মার্চ রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় মোবাইল ছিনতাইয়ের মামলায় আটকের পর ১৬ বছর বয়সী এই কিশোরকে আদালতের মাধ্যমে টঙ্গী উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠানো হয়। ওই বছরের ৮ মে জামিন পায় শিশুটি। মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। শিশুটির বাবা ভ্যানচালক (৩৮)। মা (৩৪) বাসাবাড়িতে কাজ করেন। রাজধানীর কাঁঠালবাগানের কালভার্ট এলাকায় একটি ছোট বাসায় ভাড়া থাকে তারা।

ওই কিশোর বলে, কক্ষের ভেতরে ‘বক্স পাস’, ‘চৌকি পাস’, ‘রিমোর্ট পাস’ নামে কিছু বিচিত্র নাম রয়েছে। বড় ভাইয়েরা কক্ষের ভেতরে একটু উঁচু স্থানে বসে বিচার সালিস করে, এটাই বক্স পাস। চৌকি পাস হলো সিনিয়ররা একটু উঁচুতে ঘুমাবে। ছোটরা থাকবে নিচে। কক্ষের টেলিভিশনের রিমোর্ট কন্ট্রোল থাকবে বড় ভাইয়ের হতে। এটা রিমোর্ট পাস। তার মর্জিমতো টেলিভিশন চালু ও বন্ধ হবে। হাউজ ক্যাপ্টেন ও তার সহযোগীদের অনুমতি ছাড়া কিছুই করা যাবে না। যেসব শিশু-কিশোর হাউজ ক্যাপ্টেন বা বড়দের চোখে ‘বেয়াদব’, তাদের কান ধরে ওঠবস করানো, চড়-থাপ্পড় ও মারধর করা হয়। হাউজ ক্যাপ্টেনের নির্দেশে তার সহযোগীরা এসব নির্দেশ বাস্তবায়ন করে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এগুলো শিশু উন্নয়নকেন্দ্র নয়, টর্চার কেন্দ্র। কত শিশু ওই উন্নয়নকেন্দ্র থেকে এসে মূলধারায় ফিরেছে এ নিয়ে আমাদের ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। অনেকেই আবার নতুন করে অপরাধে জড়িয়েছে। অনেক শিশু সেখানে থাকতে চায় না। বাবা-মায়েরাও উন্নয়নকেন্দ্র নিয়ে শঙ্কায় থাকেন। তার মানে সেখানে শিশুদের কাউন্সেলিং, মানসিক গঠন পাকাপোক্ত হয় না। তাহলে এ ধরনের উন্নয়নকেন্দ্র দিয়ে কী লাভ হচ্ছে?’ 

সমাজসেবা কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোতে রয়েছে ১ হাজার ৪৮ শিশু। এদের সবাই জামিন ও বিচার নিষ্পত্তির প্রতীক্ষায় আছে। এর মধ্যে টঙ্গী শিশু উন্নয়নকেন্দ্রে অনুমোদিত আসন ৩০০ হলেও রয়েছে ৬৮৭ জন। এখানে রায়ের পর আটকাদেশে আছে ৪ জন। কোনাবাড়ীর বালিকা শিশুকেন্দ্রটির আসনসংখ্যা ১৫০। সেখানে আছে ৬৫ জন। যশোরের পুলেরহাটে শিশু উন্নয়নকেন্দ্রে আসনসংখ্যা ১৫০ হলেও সেখানে আছে প্রায় দ্বিগুণ ২৯৬ শিশু। এই উন্নয়নকেন্দ্রে সাজার রায়ের পর বিভিন্ন মেয়াদে আটকাদেশে আছে ৭ জন। ধারণক্ষমতার বেশি বন্দি এবং লোকবলের ঘাটতিতে উন্নয়নকেন্দ্রগুলোর যথাযথ তদারকি বিঘ্নিত হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

টঙ্গী উন্নয়নকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক দেলোয়ার হোসেন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। যশোর শিশু উন্নয়নকেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. মঞ্জুরুল হাছান বলেন, ‘দ্বিগুণ শিশু থাকায়  ঝগড়া, ছোটখাটো মারামারির মতো ঘটনা ঘটলেও আমরা তা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে ফেলি।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরত কর্মকর্তা (উপপরিচালক) মোহাম্মদ রেজাউর রহমান বলেন, ‘যারা উন্নয়নকেন্দ্রের দায়িত্বে আছে তারা বিষয়টি দেখভাল করেন। এখন পর্যন্ত এ ধরনের অভিযোগ কেউ করেনি।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কিছু সমস্যা থাকে। কিছু সীমাবদ্ধতা ও লোকবলের ঘাটতির কারণে কেন্দ্রগুলোর তত্ত্বাবধান ও তদারকি সঠিকভাবে হয় না। আর যদি অভিযোগ থাকে তাহলে তা সুনির্দিষ্টভাবে করতে হবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button