USA

নিউইয়র্ক কেন বারবার ডুবছে, সমস্যা কোথায়

সম্প্রতি টানা বৃষ্টিতে নিউইয়র্ক নগরের বড় একটি অংশ পানিতে ডুবে যায়। এতে কয়েক লাখ মানুষ জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বৃষ্টি না কমায় পানি নামতে পারছিল না। নিউইয়র্কে এই চিত্র এবারই প্রথম নয়। এর আগেও এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার ধরন বদলে যাওয়ায় ভবিষ্যতেও এমন পরিস্থিতি হতে পারে। কেন নিউইয়র্কে বারবার বন্যা দেখা দিচ্ছে, তা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিউইয়র্ক সিটির ড্রেন, পাইপ এবং পানিশোধনকেন্দ্রের নেটওয়ার্কের ধারণক্ষমতার সীমাবদ্ধতাই সেখানকার পাঁচ বরোতে জলাবদ্ধতা হওয়ার প্রধান কারণ। নিউইয়র্ক সিটির নিষ্কাশন ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ১ দশমিক ৭৫ ইঞ্চি পরিমাণ বৃষ্টির পানি সরানো যায়। কিন্তু গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সময় সকাল আটটা থেকে নয়টার মধ্যে দুই ইঞ্চির বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরপরও বৃষ্টি চলেছে।

নিউইয়র্ক সিটিতে ৭ হাজার ৪০০ মাইল দীর্ঘ পাইপ দিয়ে ঝড়বৃষ্টি এবং নর্দমার পানি বিভিন্ন শোধনকেন্দ্র কিংবা নিকটবর্তী নদীনালায় যায়। গত শুক্রবার এই পাইপগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় সড়কপথে পানি জমে যায়। এতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় এবং অসংখ্য গাড়ি পানিতে আটকে যায়। ব্রুকলিন এবং কুইন্সের বিভিন্ন বেসমেন্ট ও পাতাল স্টেশন পানিতে ডুবে যায়।

রাস্তাঘাট এবং পথচারীদের পানিতে গড়াগড়ি খাওয়ার এসব দৃশ্য ২০২১ সালেও নিউইয়র্কের রাস্তায় দেখা গিয়েছিল। ২০২১ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে ঘূর্ণিঝড় আইডা আঘাত হানার পর এমন পরিস্থিতি হয়েছিল।

নিউইয়র্ক সিটি মেয়রের জলবায়ু নীতিমালাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ড্যানিয়েল এ. জারিলি বলেন, ‘আমরা এমন এক নতুন ধাপে আছি, যেখানে ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। যদি নিষ্কাশনব্যবস্থার ধারণক্ষমতার চেয়ে পানি বেশি হয়ে যায়, তখন তা আপনা–আপনি উপচে পড়ে। পাইপগুলো যখন পানি সামলাতে পারে না, তখন তা উপচে পড়ে।’

নিউইয়র্ক সিটির পরিবেশ সুরক্ষা বিভাগের কমিশনার রোহিত আগারওয়ালা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার ধরনে পরিবর্তন আসছে। আর দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করার মতো সক্ষমতা আমাদের অবকাঠামোগুলোর নেই।

নিউইয়র্ক সিটির প্রায় ৬০ শতাংশজুড়ে পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা এমন যে সেখানে ঝড়বৃষ্টি আর নর্দমার পানি একই পাইপ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নর্দমার পানি শোধনের কেন্দ্রগুলোতে ধারণক্ষমতার তুলনায় পানির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেলে সেগুলো সরাসরি ব্রুকলিনের গোয়ানুস খাল, ইস্ট রিভারের মতো স্থানীয় জলাশয়গুলোতে চলে যায়।

ব্রুকলিনের সড়কে জলাবদ্ধতা, এর মধ্যে ড্রেন থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করছেন একজন

ব্রুকলিনের সড়কে জলাবদ্ধতা, এর মধ্যে ড্রেন থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করছেন একজন

কুইন্স ভিত্তিক পানিনিষ্কাশন প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী ডেভ বালকান বলেন, নিষ্কাশনব্যবস্থা যদি কাজ না করে, তখন এই অপরিশোধিত পানি উপচে পড়ে এবং শহরের বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের বেসমেন্টে পানি জমে যায়।

বালকান বলেন, শুক্রবার বিভিন্ন বাড়ির মালিকেরা তাঁকে অসংখ্যবার ফোন করেছেন। তাঁর ভাষ্য, সৌজন্যের খাতিরে তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বললেও আসলে সে সময় তাঁদের জন্য করার কিছু ছিল না। বাড়ির মালিকদের নিষ্কাশনব্যবস্থা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা ছাড়া আর কিছু বলার ছিল না।

বালকান বলেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে ঝড়বৃষ্টি চলতে থাকায় কতক্ষণ নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তাও তিনি বলতে পারছিলেন না।

অবকাঠামো খাতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন

নিউইয়র্ক সিটি মেয়রের জলবায়ু নীতিমালাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ড্যানিয়েল এ. জারিলি মনে করেন, জলাবদ্ধতার এই সমস্যার সমাধানে অবকাঠামো এবং সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে।

২০২১ সালে নিউইয়র্ক সিটিবিষয়ক এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর নাম ছিল ‘দ্য নিউ নরমাল’। প্রতিবেদনে বলা হয়, আইডার মতো ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উপযোগী করে শহরের নিষ্কাশনব্যবস্থাকে সাজাতে কয়েক দশক লেগে যাবে। এর জন্য খরচ হবে ১০ হাজার কোটি ডলার। শুধু সাউথইস্ট কুইনসে খরচ হবে ২০০ কোটি ডলার।

নিউইয়র্কের মেয়রের জলবায়ুবিষয়ক দপ্তরের সাবেক পরিচালক বেন ফারনাস বলেন, অতিরিক্ত পানি যেন সরাসরি পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার মধ্যে না ঢুকে অন্য জায়গায় সরে যেতে পারে, তার জন্য ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছে নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষ। পানি সরানোর কিছু জায়গা তৈরি করা হচ্ছে।

ফারনাস মনে করেন, পানি সরে যাওয়ার জায়গা তৈরি এবং এই পানি যেন খাল বা জলাশয়ে না যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে অনেকগুলো কৌশল অবলম্বন করতে হয়। তিনি আরও বলেন, পানি ধারণের জন্য বড় বড় ট্যাংক তৈরি কিংবা রাস্তার পাশে বাগানের মতো (যেন বৃষ্টির পানি কিছুটা শুষে নেয়) সবুজ অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।

বন্যাসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৌশলী ফ্রাঙ্কো মন্টালটো বলেন, এই সমস্যার সমাধান করাটা সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জের বিষয়। কারণ, পুরোনো যে অবকাঠামো ব্যবস্থা আছে, তার ধারণক্ষমতা দিয়ে পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। হয় অতিরিক্ত এই পানি ভূগর্ভে পাঠিয়ে দিতে হবে, নয়তো মাটির ওপরে এই পানি সামলানোর মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।

পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। ৩০ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে

পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। ৩০ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে

কলম্বিয়া ওয়াটার সেন্টারের প্রকৌশলী ও পরিচালক উপমানু লাল মনে করেন, অতিরিক্ত পানির চলাচল স্বাভাবিক রাখতে এবং উপচে পড়া ঠেকাতে নগরের ড্রেনেজব্যবস্থায় আরও অনেক পাম্প স্থাপন করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের পানি সরানোর সক্ষমতা সীমিত। আর এ কারণে আরও বেশি বেশি জলাবদ্ধ পরিস্থিতির আশঙ্কা আছে।’  

উপমানু লালের সঙ্গে গবেষণা করছেন ক্যান্ডেস আগোনাফির। ঘূর্ণিঝড় আইডার সময় দেখা গেছে, বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকায় বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনব্যবস্থার দিকে সরতে পারছে না।

একটি গবেষণার অংশ হিসেবে নগরে জলাবদ্ধতা নিয়ে করা ৩১১টি অভিযোগ খতিয়ে দেখেছেন আগোনাফির। এতে দেখা গেছে, জলাবদ্ধতাজনিত বেশির ভাগ অভিযোগের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সমস্যা দায়ী।

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে জলাবদ্ধতা ঠেকাতে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, নিষ্কাশনব্যবস্থার ভেতর ও বাইরের অংশের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে শহর এলাকায় জলাবদ্ধতার কিছুটা প্রভাব কমানো যাবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button