Bangladesh

নিবন্ধন নবায়ন নেই ৪০০০০ ডাক্তারের

মাস দেড়েকের ব্যবধানে খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় অনুমতি ছাড়া ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ঘটনায় যে তিনজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা নিজেদের সরকারি দুটি নামি হাসপাতালের চিকিৎসক পরিচয় দিয়েছেন। ভুয়া চিকিৎসক ধরা পড়ার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই। এমন তিনটি বিষয়ই উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) চিকিৎসা পেশার নিয়ন্ত্রক। এ প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসকদের চিকিৎসা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি বা নিবন্ধন দিয়ে থাকে। চিকিৎসা পেশার নিয়ন্ত্রক এ প্রতিষ্ঠানটিই স্বীকার করছে, দেশে নিবন্ধনহীন ক্লিনিক হাসপাতালের পাশাপাশি অসংখ্য ভুয়া চিকিৎসক রয়েছেন। যাদের শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া দুরূহ কাজ। তবে বিএমডিসি বলছে, যে কেউ ইচ্ছা করলে ইন্টারনেটে তাদের সাইটে ঢুকে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সত্যিকারের যোগ্যতা যাচাই করতে পারেন। কিন্তু বিভিন্ন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান ঘুরে চিকিৎসকদের বেশিরভাগেরই নাম বা পদন্ডপদবির পাশে বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর দেখা যায়নি।

বিএমডিসি সূত্র জানিয়েছে, নির্দিষ্ট সময় পরপর নিবন্ধন নবায়ন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অন্তত ৪০ হাজার চিকিৎসক করেননি।

জানা গেছে, নানা ব্যস্ততা ও আলস্যের কারণে চিকিৎসকদের অনেকেই সময়মতো নিবন্ধন নবায়ন করেন না। যেহেতু বিএমডিসির পক্ষ থেকেও তেমন তাগিদ বা কড়াকড়ি থাকে না ফলে চিকিৎসকরা তেমন জরুরি মনে করেন না। কিন্তু নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটির এমন গা-ছাড়া ভাবের কারণে সুযোগ পেয়ে যায় সুযোগসন্ধানীরা। ভুয়া ডাক্তারের মতো প্রতারকরা এ ফাঁককে সুযোগ লাগায়।

জানতে চাইলে বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘আমরা একাধিক সভা-সেমিনার ও অনুষ্ঠানে চিকিৎসকদের অনুরোধ জানিয়েছি চিকিৎসকরা যে হাসপাতাল বা চেম্বারে প্র্যাকটিস করবেন, সেখানে তার নাম বা পদন্ডপদবির পাশে বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর রাখার নির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু প্রায় ৮০ শতাংশ চিকিৎসকই তাতে আগ্রহ দেখান না।’

শুধু এ নির্দেশনাই নয়, বিএমডিসির আরও কিছু নির্দেশনা যা চিকিৎসকরা মানতে অনীহা দেখান। এর মধ্যে নিবন্ধন নবায়ন করা অন্যতম।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি খতনা করাতে গিয়ে শিশু আহনাফ তাহমিদ মারা যায় মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল হাসপাতালে। আহনাফের বাবা জানিয়েছিলেন, ডা. এসএম মুক্তাদিরের তত্ত্বাবধানে তার ছেলের খতনা হয়। তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন ডা. মাহবুব ও ডা. ইশতিয়াক আজাদ। মুক্তাদির নিজেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্থোপেডিক সার্জন ও মাহবুব একই হাসপাতালের অবেদনবিদ্যা (অ্যানেস্থেসিওলজি) বিভাগের চিকিৎসক এবং ইশতিয়াক ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু বিএসএমএমইউ ও ঢামেক হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের কেউই ওই দুই হাসপাতালের চিকিৎসক নন।

বিএসএমএমইউর রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর দেখে আমি অর্থোপেডিক ও অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগে খবর নিয়েছি। উভয় বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আমাকে জানিয়েছেন, এ নামের কোনো চিকিৎসক নেই। সম্ভবত তারা ভুয়া চিকিৎসক, তাই বিএসএমএমইউর পরিচয় দিয়েছেন।

এদিকে জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল হাসপাতাল পরিচালনার অনুমতি ছিল না বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মাস দেড়েক আগে খতনা করাতে গিয়ে আয়ান আহমেদ নামের আরেকটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। দুটি শিশুকেই পূর্ণমাত্রার অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়েছিল, যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অনুমতি ছাড়াই অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে। সম্প্রতি এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এ ধরনের অভিযান আগেও দেখা গেছে। কিন্তু এগুলো বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

কলেজগেট, মোহাম্মদপুর, হুমায়ুন রোড, বাবর রোড এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, এসব এলাকায় প্রায় শতাধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের পঞ্চমতলা পর্যন্তই রয়েছে ১৯টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। একেকটি ফ্লোরে তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে ও ভেতরে চিকিৎসকদের নামের তালিকা টানানো রয়েছে। কিন্তু কারও নামের পাশে নিবন্ধন নম্বর নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যমুনা জেনারেল হাসপাতালের মালিকপক্ষ দাবি করা হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে যারা চিকিৎসক তারা সব বড় বড় হাসপাতালের ডাক্তার। ডাক্তাররা নিবন্ধন নম্বর দিতে আগ্রহী নন। আবার মন্ত্রণালয় থেকেও এরকম কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।’

আইন অনুযায়ী, বিএমডিসির নিবন্ধন সনদ ছাড়া দেশে কেউ চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন না। বিএমডিসি মেডিকেলে ভর্তি হওয়া ও ইন্টার্ন করার সময় শিক্ষার্থীদের সাময়িক দুটি নিবন্ধন নম্বর দেয়। ইন্টার্ন শেষ করার পর নিবন্ধন পেতে বিএমডিসি বরাবর আবেদন করতে হয়। বিএমডিসি যাবতীয় তথ্য যাচাই শেষে তখন পাঁচ বছরের জন্য নিবন্ধন দেয়।

গত বছরের মাঝামাঝি সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর পর আলোচনায় আসেন ডা. সংযুক্তা সাহা। তার নিবন্ধনের মেয়াদ ২০১০ সালে শেষ হয়ে গেলেও তিনি তা নবায়ন করেননি। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএমডিসির এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএমডিসি নিবন্ধন রয়েছে এমন চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে ৪০ হাজারেরই নিবন্ধন নবায়ন করা নেই। বিএমডিসি নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা থাকলেও তা প্রয়োগ না করায় কেউ ভয় পায় না। ফলে বারবার নির্দেশনা দিলেও নিবন্ধন নবায়ন করতে চান না।

যারা মেডিকেল থেকে পাস করে বিএমডিসির নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকেন, নিয়ম অনুযায়ী নিবন্ধন ও অনুমোদন পাওয়ার আগে তারা নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখতে পারেন না। কিন্তু অনেককেই দেখা যায়, অনুমোদন পাওয়ার আগেই রোগী দেখা শুরু করেন। বড় বড় পদন্ডপদবি ব্যবহার করলে বেশি রোগী টানা যাবে এমন চিন্তা থেকে অনেক ডাক্তারই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন না করেও নামের আগে ‘বিশেষজ্ঞ’ যুক্ত করে দেন। অনেক চিকিৎসককে প্রেসক্রিপশন ও ভিজিটিং কার্ডে বিচিত্র সব ডিগ্রি লিখতে দেখা যায়। এর মধ্যে পিজিটি, বিএইচএস, এফআরসিপি, এফআরএইচএস, এফআইসিএ, এফআইসিএস, এফএএমএস, এফআইএজিপির মতো বিভিন্ন ডিগ্রি ও ট্রেনিং কোর্সও রয়েছে।

বিএমডিসি সূত্রে জানা যায়, এসব ডিগ্রি কোনো স্বীকৃত চিকিৎসা শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা বিএমডিসি স্বীকৃত নয়। সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে প্যারামেডিকেল, ফিজিওথেরাপি কিংবা হোমিওপ্যাথি পাস করলেও তাদের নামের আগে ডাক্তার ব্যবহার করার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কেন্দ্রীয় মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ভুয়া ডাক্তার নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। শুধু তদারকির অভাবেই ভুয়া ডাক্তারদের শনাক্ত করা ও আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় ব্যস্ত বড় বড় প্রকল্প নিয়ে, সিভিল সার্জন সবসময় মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সঙ্গে মিটিং করতে করতেই দিন পার করেন। আর বিএমডিসি তো শুধু নিবন্ধনই দেয়।’ তিনি মনে করেন, ভুয়া ডাক্তার শনাক্ত, লাইসেন্স নবায়ন, ভুল চিকিৎসা তদারকি করতে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।

গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে মুনিয়া খান নামে এক ভুয়া চিকিৎসককে আটক করেন আনসার সদস্যরা। জানা গেছে, মুনিয়া চিকিৎসক সেজে রোগীদের ভালো চিকিৎসার আশ্বাস দিয়ে পাশের এলাকার ক্লিনিকগুলোতে ভাগিয়ে নিয়ে যেতেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার জননী ক্লিনিকে মাহফুজ আলম নামে ভুয়া চিকিৎসক বিভিন্ন সময় শতাধিক রোগীর অস্ত্রোপচার করেন। একপর্যায়ে ভুল চিকিৎসায় এক রোগীর মৃত্যু হলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর পুলিশ জানতে পারে মাহফুজ মূলত মাসুদ রানা নামে এক এমবিবিএস চিকিৎসকের সনদ জাল করে চিকিৎসক বনে গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, ‘কোনো নিবন্ধিত হাসপাতালে যদি ভুয়া চিকিৎসক বা বিএমডিসির নিবন্ধনভুক্ত নয় এমন কেউ চিকিৎসা কার্যক্রম চালান, তাহলে আমরা সেই হাসপাতালের নিবন্ধন বাতিল করে হাসপাতাল বন্ধ করে দিই।’

Show More

7 Comments

  1. I was wondering if you ever thought of changing the
    structure of your blog? Its very well written; I love what
    youve got to say. But maybe you could a little more in the way of content so people could connect with it better.

    Youve got an awful lot of text for only having 1 or 2
    pictures. Maybe you could space it out better?

    My webpage: vpn special coupon code 2024

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button