‘নির্বাচনী সাজার’ ফাঁদে
একের পর এক সাজার রায় হচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের অনেক নেতাই অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। ফৌজদারি মামলায় দন্ডিত ও সাজাপ্রাপ্তদের বিষয়ে সংবিধানের বিধান ও উচ্চ আদালতের ব্যাখ্যা তা-ই বলছে।
বিএনপির আইনজীবীরদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে (২০ নভেম্বর পর্যন্ত) শুধু ঢাকার আদালতে ২১ মামলায় (বেশিরভাগ দাঙ্গা, নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলা) ২৭১ নেতাকর্মীর সাজা হয়েছে। এক বছরে ২৯ মামলায় ৩০৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এসব মামলা ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দায়ের করা।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে দুর্নীতির মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় কয়েক মাস আগে হাইকোর্টে বহাল থাকে।
সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অবরোধ, হরতালের মতো কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। দলটি সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন গত সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। বিএনপি সেই তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে।
দলটির আইনজীবীদের আশঙ্কা, নির্বাচনের আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ অনেক শীর্ষ স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে নাশকতা ও দুর্নীতির অভিযোগে করা মামলার বিচার নিষ্পত্তি ও সাজা হতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় কমপক্ষে দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত হলে এবং সাজা থেকে মুক্তি লাভের পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যায় কিছুদিন আগে হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয়, সাজা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে কেউ অংশ নিতে পারেন না।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির আইনজীবীরা বলছেন, সরকার আদালতকে ব্যবহার করে বিএনপির নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাড়াহুড়ার বিচারে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিচার ও সাজা হচ্ছে। এমনকি যাচাই না করেই ‘মৃত’ ও ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের সাজা দিচ্ছে। দেশের বিচারিক ইতিহাসে এ ধরনের পরিস্থিতি নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেন তারা।
নির্বাচনের অযোগ্যতা নিয়ে সংবিধান ও হাইকোর্টের ব্যাখ্যায় যা আছে : জাতীয় ও স্থানীয় যেকোনো নির্বাচনে কোনো ব্যক্তির নির্বাচনে অযোগ্যতার বিষয়ে সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হলে এবং অভিযোগ থেকে মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। দুর্নীতির মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা আমানউল্লাহ আমানসহ পাঁচ নেতার দন্ড স্থগিতের আবেদন প্রায় পাঁচ বছর আগে খারিজ হয়। হাইকোর্টের ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গত ২২ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্যতা নিয়ে সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বিচারিক আদালত তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়ার পর তাদের আপিল (হাইকোর্টে) বিচারাধীন। আপিল বিচারাধীন থাকলেও ধরে নিতে হবে তারা দন্ডিত বা দোষী সাব্যস্ত।
রায়ে বলা হয়, ‘ফৌজদারি মামলায় দন্ড বা সাজা স্থগিত বা বাতিল না হলে কারও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। দন্ড ও সাজার বিরুদ্ধে আপিল আদালত কারও জামিন বা সাজা স্থগিত করলেও দন্ডিত ব্যক্তি সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্যতার দায় থেকে অব্যাহতি পান না। তাই কোনো উপযুক্ত আদালতে সাজা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের এই বিধান কার্যকর থাকবে। ফলে দোষী সাব্যস্ত বা দন্ডিত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিলে তা হবে সংবিধান পরিপন্থী।’
তবে, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, হাইকোর্টের এই রায়ের বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি কিংবা চূড়ান্ত হতে হবে। অবশ্য, সেটা খুব শিগগির হবে কি না, সেটি দেখার বিষয়। তিনি বলেন, ‘দ-িতদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে অতীতে হাইকোর্টের অন্য রায়ে বলা হয়েছে, চূড়ান্ত আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন করতে পারবেন। আবার এখন রায় আসছে পারবেন না। সাধারণ বিধান হলো, হাইকোর্টের রায়ে যখন ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকে, তখন আপিল বিভাগে এটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত হয় না। সুতরাং রায়ের এ বিষয়গুলো আপিল বিভাগে চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত বিতর্ক থেকে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিচারে কারও শাস্তি হলো, নির্বাচনে অংশ নিতে পারলেন না। কিন্তু দুই-তিন বছর পরে আপিলে যদি কাউকে নির্দোষ ঘোষণা করে তখন কী হবে? ওই ব্যক্তি তো সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেন।’
শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমার ধারণা, আগামী নির্বাচনের আগে কোনো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশন বাতিল করার পর তার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যদি রিট হয়, তখন কী পরিস্থিতি হবে সেটাও দেখতে হবে।’
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কৌঁসুলি মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘হাইকোর্ট যে রায়টি দিয়েছিল, সেটিতে কোনো স্থগিতাদেশ নেই। যেহেতু স্থগিতাদেশ নেই তাই আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ রায়টিকেই ধরে নিতে হবে। এর মানে হচ্ছে, কেউ ফৌজদারি মামলায় দ-িত হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।’
বিএনপির আইনজীবীদের কাছে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি : উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনা করেন এমন বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছে । তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের ১৫ বছর মামলা, গ্রেপ্তার, জামিন আর শুনানি নিয়ে তাদের ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইন আদালতকেন্দ্রিক এ ব্যস্ততা বাড়বে, সেটিও অনুমিতই ছিল। কিন্তু মামলার রায় ও সাজা নিয়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে তারা অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত মনে করছেন। ঢাকার ফৌজদারি আদালতে বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা অভিযোগ করেন, ফৌজদারি বিধানের অনেক কিছুই বিচারকাজে অনুসরণ না করেই একের পর এক সাজার রায় হচ্ছে। এমনকি মামলার বিচারকাজ শুরু কিংবা শুরুর আগে অধস্তন আদালতের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না তাদের।
অধস্তন আদালতে বিএনপির অন্যতম আইনজীবী ও দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘ঢাকার সব আদালতে মামলা মানেই রাজনৈতিক নেতাদের মামলা। প্রতিদিনই বিচারের জন্য শুনানি হচ্ছে। রায় ও সাজা হচ্ছে। সরকারপক্ষ এই মুহূর্তে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চাইছে। সে ক্ষেত্রে সময় চাইলে যুক্তিসংগত সময় অতীতের মতো আর পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে প্রতিকারের জন্য উচ্চ আদালতে যেতে চাইলে সে সময়ও মিলছে না।’
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘শুধু তাড়াহুড়োই নয়, প্রহসনের বিচার চলছে। বিচারিক আদালতে বিচারের নামে যা হচ্ছে তা “জুডিশিয়াল ক্র্যাকডাউন”-এর মতো। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এত দ্রুত বিচারের রায়ের নজির নেই। “মৃত”, “গুম” হওয়া ব্যক্তিদের সাজা দেওয়ার নজিরও আর কোথাও নেই। এটি হচ্ছে কেবলই নির্বাচন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাদের সাজা হচ্ছে তারা আপিল কিংবা জামিন চাইলেও নিষ্পত্তি দ্রুত হবে না। আমাদের আশঙ্কা, নির্বাচন পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলবে।’
তবে, বিএনপির আইনজীবীদের এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘তারা (বিএনপির আইনজীবী) এমন কথা সব সময়ই বলেন। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। এসব মামলায় সাক্ষী এসেছে। শুনানি হয়েছে। অপরাধ প্রমাণ হয়ে বিচারের রায় হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই।’