নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ ‘ওরা এখন মুখোমুখি’
জাতীয় সংসদের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) মধ্যে শুরু হয়েছে কামড়াকামড়ি। ২০১৪, ২০২৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে জাতীয় পার্টি সংসদে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা উপেক্ষা করে আসন ভাগাভাগির নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি তিন বারই জাতীয় সংসদে বিরোধি দলের আসনে বসেছে। দলটির বিরোধী দল এবং একই সঙ্গে কয়েকজন নেতা মন্ত্রীও হয়েছেন। ওই সময় বিরোধী দলের নেতা ছিলেন রওশন এরশাদ। এবার বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন জিএম কাদের। ‘২৬ আসন সমঝোতা’ করে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে মাত্র ১১ আসন পেয়েছে জাতীয় পার্টি। এতে করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সুবিধাবাদী পরগাছা দলটির অনেক নেতা মূল দল ত্যাগ করে পৃথক দল গঠন করেছেন। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে ওই দল এখন নতুন করে সরকারের অনুকম্পা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ২৬ আসনে সমঝোতা করে মাত্র ১১ আসন পাওয়ায় জাতীয় পার্টির সুবিধাবাদী নেতারা বেহায় ক্ষুব্ধ।
দলটির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের ২৭ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় বলেছেন, আওয়ামী লীগে রাজনৈতিক কোনো চরিত্র নেই। দেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। জনগণ নয় বিদেশী শক্তি তথা ভারত, চীন ও রাশিয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে। জি এম কাদেরের এই বক্তব্যে ক্ষেপে গেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি গতকাল বলেছেন, ‘৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে কোনো বিদেশি শক্তির প্রভাব ছিল না। জাতীয় পার্টি কোন চাপে নির্বাচনে এসেছে তা দলটিকে পরিষ্কার করতে হবে’। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির বর্জনের মধ্যে জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারতের সহায়তায় আসন ভাগাভাগি করে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দুই দলের নেতাদের মধ্যে ঝগড়া এখন ওপেন সিক্রেট। জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে পরিস্কার তারা (দুই কাদের) একে অপরের মুখিমুখি অবস্থান করছেন। জনগণকে বোকা বানিয়ে নির্বাচনের নামে পাতানো আসন ভাগাভাগি করে জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদে গেলেও দুই দলের নেতারা যে একে অপরের উপর বিক্ষুব্ধ তা দুই নেতার বক্তব্যে পরিস্কার।
গত শনিবার রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভায় দলের তৃণমূলের নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে কেন নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন কারণ জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, আগেই বুঝেছিলাম, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে বৈঠকে করে পরিষ্কার বুঝেছি, তিনটি বিদেশি (ভারত, চীন, রাশিয়া) বড় শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে এবং নির্বাচন সফল করতে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু তারা নয়, আরো বেশ কয়েকটি বিদেশি শক্তি আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করতে প্রস্তুত ছিল।
বিরোধী দলের নেতা ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দরকষাকষি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন অংশগ্রহণ করা হয়নি। ২৬টি আসন আমাদের ছাড় দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ওই ২৬টি আসনে তাদের প্রার্থী দিয়েছে। নির্বাচনে আমি কোনো মনোনয়ন বানিজ্য করিনি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সরকারি দল থেকে টাকা নিয়েছি তাও অসত্য। ৭ জানুয়ারিরর নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে জাতীয় পার্টি বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চলছে তা অসত্য এবং বিব্রতকর। আমার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও নির্বাচন হতো। অন্যজনের জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত। সে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। এর আগে ডয়সে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জিএম কাদের বলেন, ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক রেখে এরশাদ রাজনীতি করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে তাদের পরামর্শ নিয়ে রাজনীতি করছি।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে জিএম কাদেরের হাটেহাড়ি ভেঙ্গে দেয়াকে আওয়ামী লীগ ভালভাবে নেয়নি। গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের ৭১তম জন্মদিন বনানী কবরস্থানে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কোনো বিদেশি শক্তির প্রভাব ছিল না। জাতীয় পার্টি কোন চাপে নির্বাচনে এসেছে তা দলটিকে পরিষ্কার করতে হবে’। তিনি আরো বলেন, ‘কে কাকে হুমকি দিয়েছে? তাদের (জাতীয় পার্টি) জন্ম তো বন্দুকের নলে। তারা গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে আসেনি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশের ৪২ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। ভোটের দিন কোনো খুন খারাপি হয়নি। এখানে আমরা কোনো চাপ অনুভব করিনি। তিনি (জিএম কাদের) কোন কারণে, কার চাপে নির্বাচনে এসেছেন সেটা তাকেই (জিএম কাদের) পরিষ্কার করতে হবে।’
অবশ্য নির্বাচনের পর ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সচিবালয়ে ঢাকায় কর্মরত ভারতের হাইকমিশনার প্রণব ভার্মা সাক্ষাৎ করতে গেলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচনে পাশে থাকার জন্য ভারতকে ধন্যবাদ। ভারত পাশে ছিল বলেই বিদেশী শক্তির চাপের মুখেও ৭ জানুয়ারি নির্বাচন ভঙ্গুল হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পেরেছে’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময় ভারত যেভাবে আওয়ামী লীগের পাশে ছিল সারাজীবন পাশে থাকবে’। অথচ ভারতের অনুকম্পায় নিয়ে রাজনীতি করা দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এখন ভারত ইস্যুতে মুখোমুখি। জাপার দাবি ভারত, চীন, রাশিয়া ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল। ওবায়দুল কাদের এর আগে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পাশে ভারত থাকার কথা স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছেন। এখন তিনি তা অস্বীকার করে জাপার চেয়ারম্যানকে বলছেন, কারা চাপ দিয়ে জাপাকে নির্বাচনে এনেছে বলতে হবে। খেলা বেশ জমে গেছে। উল্লেখ, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ওই নির্বাচনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা শিং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে এরশাদকে চাপ দিয়ে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল।