Bangladesh

পররাষ্ট্র সচিব-মার্কিন রাষ্ট্রদূতের রুদ্ধদ্বার বৈঠক: ‘কী কথা হলো তার সাথে?’

‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে’ (ওবায়দুল কাদের)। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্য ভাইরাল হয়ে নেট দুনিয়ায় ভাসছে। এই ‘তলে তলে’ তথা পর্দার আড়ালে কি হচ্ছে তা বোঝা সত্যিই কঠিন। রাজনৈতিক সহিংসতা, নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত এক মাসে মন্ত্রী, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অসংখ্য বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। কিন্তু গত ২ নভেম্বর পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা’য় দেড় ঘন্টাব্যাপী ওই বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে তা খোলাসা করা হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মার্কিন দূতাবাস বৈঠকের এজেণ্ডা এবং আলোচনা নিয়ে মুখ খুলেনি। যদিও মার্কিন দূতাবাস বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তুকে পাশ কাটিয়ে মামুলি একটি বক্তব্য দিয়েছে। রুদ্ধদার ওই বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কানাঘুষা এবং নেট দুনিয়ায় তোলপাড় হচ্ছে। তবে বেশির ভাগই বলছেন, ওই বৈঠক রহস্যজনক।

উল্লেখ, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি নির্ধারনি এবং সিরিয়াস বিষয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বা মার্কিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করে থাকেন। অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে গুরুত্ব দেন না। বাংলাদেশের ওপর ভিসা নীতি গ্রহণ এবং ভিসা নীতি কার্যকরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব দু’জনই যুক্তরাষ্ট্রে সফলে থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দু’টি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনকে জানিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। তবে মার্কিন প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা তাদের বার্তা দিতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও দু’একটি বৈঠক করেছেন।

গত বৃহস্পতিবার সকালে অতি গোপনীয় ভাবে আলোচিত সচিব-রাষ্ট্রদূত বৈঠক হয়। অন্যান্য বৈঠকের আগে বৈঠকের খবর সংগ্রহের কথা জানানো হলেও এ বৈঠক হয় রাখঢাক করেই। বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মার্কিন দূতাবাস কোনো পক্ষই খোলাসা করে কিছু বলেনি। ধারণা করা হচ্ছে, সচিব-রাষ্ট্রদূত বৈঠকে দেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সম-সাময়িক রাজনৈতিক বিষয়াদি বিষয়ে কথা হয়েছে। চলামান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনায় আসতে পারে, বিশেষত নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বার্তা আদান-প্রদান হতে পারে। দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসান এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গ্রহণযোগ্য পথ খুঁজতে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ চায় যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বাংলাদেশের বন্ধু-উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাই কমিশনার সংলাপে বসে রাজনৈতিক বিরোধী মীমাংসা করতে সরকার ও বিরোধী দল এবং নির্বাচনী স্টেকহোল্ডারদের নিয়মিতভাবে চাপ অব্যহত রেখেছে। গত ৩১ অক্টোবর মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বৈঠক শেষে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শর্তহীন সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানান। সুত্রের দাবি পিটার হাস আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া যায় কিনা তা নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি শর্তহীন সংলাপের আয়োজন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। ওই সময় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ার বলেন, নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারনেই যথা সময়ে নির্বাচন করতে হবে।

মার্কিন দূতের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, রাজনীতি ছাড়াও দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক ইস্যু রয়েছে, যা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে রাষ্ট্রদূতের কথা বলা বা আলোচনার জন্য সরকারী সিস্টেমে বহু উইন্ডো ওপেন রয়েছে।
মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে পিটার হাসের বৈঠক বিষয়ে জানতে মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় মুখপাত্র বলেন, কূটনীতিক হিসাবে আমরা বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে কথা বলি। নাগরিক সমাজ এবং বেসরকারি সংস্থা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী নেতা, চেম্বার অব কমার্স, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সরকারী কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ অনেকের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। এসব যোগাযোগ বা আলাপ-আলোচনা বাংলাদেশ সম্পর্কে আরো ভালোভাবে আমাদের বুঝতে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।
তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচিব-রাষ্ট্রদূতের বৈঠকের আলোচনা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মার্কিন দূতাবাস হয়তো কিছু লুকাচ্ছেন। এর আগে গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের ওপর নতুন ‘ভিসা নীতি’ ঘোষণা করে বলেছিলেন ৩ মে এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ওই তথ্য গোপন করেছিল। এ ব্যপারে সাংবাদিকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে চানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘আমরা কেন প্রকাশ করবো ওদের (যুক্তরাষ্ট্র) সিদ্ধান্ত ওরা প্রকাশ করুক।’

এই কয়েকদিনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছাদুজ্জামান খান কামাল, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রতিটি বৈঠকের পর আলোচনার বিষয়বস্তু কখনো সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে জানিয়েছেন। কিন্তু ২ নভেম্বর পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে রুদ্ধদার বৈঠকের এজেণ্ডা ও তথ্য রহস্যজনকভাবে গোপন করা হচ্ছে। ফলে সর্বোত্রই জিজ্ঞাসা কী আলোচনা হয়েছে পররাষ্ট্র সচিব-মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওই রুদ্ধদার বৈঠকে? পিটার হাস কী কোনো নতুন বার্তা দিয়েছেন?

প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়, সে বিষষে বার্তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছর দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে ঢাকা ও ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত সব বৈঠকের আলোচনার অন্যতম বিষয় আগামী নির্বাচন। এই দেড় বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি পর্যায়ক্রমে ঢাকা সফর করেন। একবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ওয়াশিংটনে ডেনে নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্যই। প্রভাবশালী দেশটি বলেছে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন দেখতে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব মুখিয়ে রয়েছে। কিছুদিন আগে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) সমন্বয়ে গড়া যুক্তরাষ্ট্রের পাকনির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ঢাকা সফর করেন। ফিরে গিয়ে তারা পাঁচ দফা সুপারিশ দেন। এরপর থেকে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে সংলাপের জোড়ালো আহবান জানাচ্ছে।

এর মধ্যে গত ২৯ অক্টোবর ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে দেশটির বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আজরা জেয়া বলেছেন, ‘বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের পাঁচ দফা সুপারিশকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র।’ এদিকে যুক্তরাজ্যের ঢাকার কর্মরত হাইকমিশনার সারাহ কুক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রতিটি বৈঠকে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যপারে জানতে চান। তবে ওয়াবদুল কাদেরের ‘তলে তলে’ বক্তব্য সবার প্রশ্ন আসলে তলে তলে কী হচ্ছে? পররাষ্ট্র সচিব ও পিটার হাসের মধ্যে কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো যা প্রকাশ করা যাচ্ছে না? অনেকটা জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো সবার জিজ্ঞাসা ‘কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে’।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button