পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো নিয়ে যা ঘটছে
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণের জন্য ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল এবং বাংলাদেশে শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন এ কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, তারা আশা করছেন যে এই সময়ের মধ্যই নতুন মজুরি নির্ধারণ করার ঘোষণা আসবে।
তৈরী পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, নভেম্বরের মধ্যেই মজুরি পুনঃনির্ধারণের ঘোষণা দেয়া হবে। তবে সেটি কবে সে বিষয়ে কোনো দিনক্ষণ জানাননি তিনি।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে মজুরি বোর্ড, সরকার ও গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যে সমঝোতা আলোচনা চলছে। চতুর্থ ধাপের আলোচনা বুধবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। আরো দুয়েকবার আলোচনার পর সব পক্ষের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এর আগে বাংলাদেশে ২০১৮ সালে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি আট হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকদের বেতন পুনরায় নির্ধারণ করার নিয়ম রয়েছে।
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কত হবে তা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে এখন আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে সর্বনিম্ন মজুরি ২৩ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
একে অযৌক্তিক দাবি বলে উল্লেখ করেছে বিজেএমইএ। সংস্থাটির পক্ষ থেকে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ১১ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
এখন উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতার চেষ্টা করা চলছে।
যা ঘটছে
মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে পোশাক শ্রমিকরা। বুধবারও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, গত প্রায় সপ্তাহ খানেক সময় ধরে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছে পোশাক শ্রমিকরা। ঢাকার মিরপুর, খিলগাঁও ছাড়াও আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুর এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।
শ্রমিক নেতা আমিরুল হক বলেন, পোশাক শ্রমিকরা বিক্ষোভ করলেও ভাঙচুর ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য তারা দায়ী নয়।
তিনি বলেন, ‘শুক্রবার থেকে শ্রমিকরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমেছে। আর বেশিরভাগ জায়গায় শ্রমিকরা নয়, বরং বহিরাগত ও ঝুট ব্যবসায়ীদের লোকজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। বিক্ষোভকে আমরা ধারণ করলেও ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও, অবরোধ- এগুলা গার্মেন্টসের শ্রমিকদের সহযোগিতা করবে না, বরং এটা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এর জন্য মজুরি বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত পোশাক শ্রমিকদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নভেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যেই এই সঙ্কটের সমাধান হবে বলে আশা করছেন তারা।
শ্রমিকদের প্রস্তাব কী?
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা এবং পোশাক শ্রমিক শিল্পী বলেন, তিনি বুধবার সকাল থেকে নতুন মজুরির দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। দুপুরে বাসায় ফিরেছেন।
তিনি বলেন, ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ করছেন তারা। তাদের এ দাবি মেনে নেয়া না হলে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলেও তিনি মনে করেন।
তিনি প্রশ্ন করেন, ‘২৫ হাজার টাকা কি আমরা বেতন বেশি চাইয়া ফালাইছি? যে হারে দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে বলেন। এই হিসেবে ২৫ হাজার কি গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেশি চাইছে?’
শিল্পী জানান, নতুন এই মজুরির পাশাপাশি তাদের আরো দাবি রয়েছে। আর সেটি হচ্ছে, এক বছর পর পর বেতন বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সব কিছুর দাম কিন্তু আমাদের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করে না। সব কিছুর দাম বাড়ছে, যেমন কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল। কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন বাড়ে না।’
এদিকে পোশাক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন ২৩ হাজার টাকা মজুরির দাবি উত্থাপন করেছেন তারা। এই বেতনের মধ্যে ৬৫ শতাংশ মূল বেতন, বাৎসরিক ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, সাতটি গ্রেডের পরিবর্তে পাঁচটি গ্রেড করার দাবি তারা তুলে ধরেছেন। এই দাবির সাথে অন্য শ্রমিক সংগঠনগুলোও ঐক্যমত্য জানিয়েছে।
গত ৮ অক্টোবর পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা করার প্রস্তাব দেয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। মূল্যস্ফীতিসহ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সংস্থাটি নয় হাজার ৫৬৮ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করে সংস্থাটি।
রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই সময় সংস্থাটি জানিয়েছিল, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত নীতিমালার আলোকে এই ন্যূনতম মজুরি বিবেচনা করেছেন তারা।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের ৭৬টি পোশাক কারখানার উপর জরিপ করে সংস্থাটি জানায়, ২৭ শতাংশ কারখানা মালিক মনে করেন তারা ১২ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দিতে পারেন।
যা বলছে মালিকপক্ষ
তৈরী পোশাক উৎপাদন ও রফতানিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, শ্রমিকদের মজুরি কত হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে একটি মজুরি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মালিকপক্ষ, সরকার এবং শ্রমিক পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে এরই মধ্যে চতুর্থ দফা আলোচনাও বৈঠক হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, মজুরি যাই হোক না কেন সেটি নভেম্বর মাসের মধ্যেই ঠিক করা হবে। ডিসেম্বর থেকে এই নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর করা হবে। আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুতে বেতনের সাথে নতুন ঘোষিত মজুরি শ্রমিকদের বুঝিয়ে দেয়া হবে।
শ্রমিকদের প্রস্তাবের বিষয়ে আজিম বলেন, শ্রমিকরা যে প্রস্তাব দিয়েছে তা আসলে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এটি মেনে নেয়া হলে অনেক কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।
তিনি বলেন, ‘শুধু বললেই তো হবে না, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ… এটা শ্রমিক-মালিক সবার মধ্যেই একটা মিল থাকতে হবে। এভাবে বললে দেখা যাবে অনেকে চালাইতে (কারখানা) পারবে না। বন্ধ হয়ে যাবে। ডিসিশনটা যেটা হয়, শ্রমিকদেরও বাঁচতে হবে, ফ্যাক্টরিও চালাইতে হবে।’
বিজিএমইএর এই ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, মজুরি বোর্ড মূল্যস্ফীতির মতো সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।
সরকার, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ- সব পক্ষ থেকেই একটি করে প্রস্তাব দেয়া হয়। এরপর আলোচনার পর একটি অভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মজুরি নির্ধারণের বিষয়ে।
চলতি বছর মালিকপক্ষ ১১ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি করার প্রস্তাব দিয়েছে। শ্রমিকদের দাবি করে মজুরি এবং মালিকপক্ষের দেয়া প্রস্তাবের মধ্যে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার পার্থক্য রয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে শ্রমিকদের যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল বর্তমান সময়ের সাথে সেটি তুলনা করে ৩০ শতাংশ মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
ওই সময় তৈরী পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল আট হাজার টাকা বা ৯৫ ডলার ৩৫ সেন্ট।
গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ রাখার একটা হুশিয়ারি দেয়া হয়েছিল মালিকপক্ষের দিক থেকে। এ বিষয়ে আজিম বলেন, মজুরি ঘোষণার আগেই একটি অস্থির অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। যার আসলে যৌক্তিকতা নেই।
তিনি বলেন, ‘দেখা যায় শ্রমিকদের মধ্যে বাইরে থেকে একটা উস্কানি হয়। সব মিলিয়ে একটা ঝামেলা হয়। যে ফ্যাক্টরিগুলো চলছে সেগুলো চলবে। আর যদি কোনো ফ্যাক্টরি বন্ধ করে ভাঙচুর করা হয়, তাহলে সেগুলো বন্ধ থাকবে। সবকিছুই আইন মেনে করা হবে।’
নির্বাচনের আগেই দাবি আদায়ের আশা শ্রমিকদের
মজুরি বাড়ানোর দাবি মানার বিষয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো আশাবাদী হলেও শ্রমিকরা বলছে, তাদের দাবি মানা না হলে আরো বড় আন্দোলনে যাবেন তারা।
পোশাক শ্রমিক শিল্পী বলেন, এরই মধ্যে যেহেতু মজুরি বাড়ানোর দাবি জানাতে গিয়ে দুই শ্রমিক নিহত হয়েছে, তাই তাদের এ দাবি পূরণ করা না হলে আন্দোলন থেকে সরবে না তারা। একই সাথে যারা নিহতদের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘এখন তো দুই শ্রমিক মাইরা ফালাইছে, এখন তো ২৫ হাজারে কমে কেউ মানবে না। এখন সব শ্রমিক নামবে রাস্তায়।’
পোশাক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে যে দাবিগুলো তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো ১৫ নভেম্বরের মধ্যে মেনে নেয়ার সময় বেধে দেয়া হয়েছে।
তারা আশা করছেন, এই সময়ের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে মজুরি বোর্ড ও মালিক পক্ষ।
এর কারণ হিসেবে আমিরুল হক বলেন, সামনে যেহেতু নির্বাচন এবং খুব দ্রুতই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার শ্রমিকদের বিষয়টি সমাধানে এটি আমলে নিবে বলে মনে করেন তারা।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ী মহল লক্ষ্য করেছে যে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভকে অনেক রাজনৈতিক দলও তাদের অনুকূলে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। যা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। এ কারণে তাদের দাবি শিগগিরই পূরণ হবে বলে মনে করেন তারা।