Bangladesh

প্রকাশ্যে চুপ ভেতরে চাপ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিদেশি তৎপরতা আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি প্রয়োগ শুরুর ঘোষণা দিয়ে এবং নতুন শ্রমনীতি গ্রহণ করে চাপ দিয়ে রেখেছে। শ্রমনীতি ঘোষণা করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, শ্রম অধিকার হরণ করা হলে প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।

সরকারের তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞার পরিস্থিতি অস্বীকার করা হলেও তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে।

এরই মধ্যে গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জে দলীয় সভায় বলেছেন, তারা (বিএনপি) এত দিন বলেছে নির্বাচন হতে দেবে না। এখন যখন মনে করছে নির্বাচন হয়ে যাবে; তাহলে কী করা যাবে? আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে বাংলাদেশে এমন অবস্থা করবে, দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। এটা হচ্ছে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। এটা শুধু দেশের নয়, বিদেশি একটা প্ররোচনাও আছে।

একই দিন সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কার বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা এলে দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার জন্য তা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন (ইসি) দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। সেই তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট হবে।

এর দুদিন আগে ১৩ নভেম্বর সর্বশেষ শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করা বিএনপিকে চিঠি দেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপ করতে রাজি হয়নি। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশিদের তৎপরতা তখন থেকে আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।

কূটনৈতিক সূত্র ও বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের আগে আপাতত যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিরা নীরবই থাকবে, এমনটাই দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন-প্রক্রিয়া নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে।

এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল নির্বাচনের আগের ও পরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সফরে রয়েছে। তারা ইসি ও বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করছে। আসার কথা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) একটি যৌথ দল অক্টোবরে ঢাকা সফর করে গেছে।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে প্রায় দুই বছর ধরে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। তারা সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে আসছে। একই প্রত্যাশার কথা বলে আসছে জাপান, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। তবে জাপানের সক্রিয়তা এখন আর চোখে পড়ে না।

অন্যদিকে প্রতিবেশী ও বন্ধু দেশ ভারত, চীন ও রাশিয়া তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এই তিন দেশের অভিন্ন মত হলো বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির নিজস্ব বিষয়। চীন ও রাশিয়া মনে করে, এ বিষয়ে চাপ দেওয়া কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। অন্যদিকে ভারত বলে আসছে, বাংলাদেশের নির্বাচন কীভাবে হবে, সেই সিদ্ধান্ত দেশটির জনগণই নেবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কেউই বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে কিছু বলেনি।

অবশ্য গণতন্ত্র ক্ষুন্ন ও অবাধ নির্বাচনে বাধা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না এমন নীতি ঘোষণা করেছে গত ২৪ মে। জুলাই মাসে এই ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়।

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর নভেম্বর থেকে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে দলটি। নভেম্বর ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলন ঘিরেও ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ওই মাসেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করে। সেই নীতি সব দেশের জন্য প্রযোজ্য হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যখন সেটা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন, তখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন। তিনি বলেছেন, যারা হুমকি দেয়, ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী বা শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে, তাদের যুক্তরাষ্ট্র জবাবদিহির আওতায় আনবে। প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে শাস্তি, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো যত বিষয় রয়েছে তার সবই ব্যবহার করা হবে। তিনি বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিক অধিকারকর্মী কল্পনা আক্তারের কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি জীবিত রয়েছেন। কারণ মার্কিন দূতাবাস তার পক্ষে কাজ করছে।

ওই সময় বিশ্লেষকদের অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষণায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য বাড়তি উদ্বেগের জায়গা রয়েছে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মিশন থেকে দূতাবাসের মিনিস্টার মো. সেলিম রেজার সই করা একটা চিঠি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেই চিঠিতে সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারকে সতর্ক করে বলা হয়, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই শ্রমনীতির অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে।

গত শনিবার বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, ভূরাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত ১৬ থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটি কাটিয়ে ঢাকা ফিরেছেন। তার ছুটিতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে তুমুল আলোচনা হয়। পিটার হাস ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরলে আবার তৎপরতা শুরু হবে এমনটাও আলোচনায় ছিল। কিন্তু কয়েক দিন ধরে তেমনটা দেখা যায়নি।

তবে ১৯ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিদেশিরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলবেন না বলে তিনি মনে করছেন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশিরা হয়তো নির্বাচনের আগে আর তেমন কোনো তৎপরতা দেখাবে না। তবে পরে কী হয়, সেটি এখন বলা মুশকিল।

উল্লেখ্য, চলতি মাসেই গণতন্ত্র ক্ষুন্ন করার কথা বলে আফ্রিকার দুই দেশ উগান্ডা ও জিম্বাবুয়ের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ ছাড়া মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে র‌্যাব ও বাহিনীটির কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এবারও ১৩ দেশের ৩৭ ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটি। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য ও কানাডা অর্ধশত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার বেশি তৎপর ছিল। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের কথা বলেছে। তাদের প্রত্যাশার বিপরীতে ভিসানীতি প্রয়োগের বিষয়টিও বলেছে। অন্যদিকে ভারত, চীন ও রাশিয়া তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এই তিন দেশ মনে করে, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। কাজেই নির্বাচনের দিকে সবার নজর রয়েছে। তারা নিবিড়ভাবে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button