International

প্রযুক্তির অপব্যবহারে বিপর্যস্ত তরুণ প্রজন্ম, উত্তরণের উপায় কী?

পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে প্রযুক্তি। বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনেছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি। বিভিন্ন উদ্ভাবনের ফলে বর্তমান বিশ্ব এগিয়েছে অনেক দূর, তাল মিলিয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশও। কিন্তু প্রযুক্তির অসংখ্য ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও অপব্যবহার গ্রাস করছে তরুণ প্রজন্মকে। প্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকগুলো যেন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তরুণদের। এমনটাই মনে করছেন প্রযুক্তিবিদরা।

ভয়ংকর সব অপরাধে তরুণদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশজুড়ে হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ ছোটখাটো নানা অপরাধে জড়াচ্ছে উঠতি বয়সীরা। এ জন্য প্রযুক্তির পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যে জিনিসগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে, সেটি পুঁজিবাদী সমাজের একটি অংশ। মূলত মুনাফার জন্য এ নতুন সংস্কৃতিগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। যা তরুণ প্রজন্মের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পারিবারিকভাবে তাদের সামনে উন্নত আদর্শ তুলে ধরা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে এসব অপরাধ থেকে তরুণ প্রজন্মেকে বিরত রাখা সম্ভব।

33

প্রযুক্তির এমন অপব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও। অনেকটা বাধ্য হয়ে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোন অথবা ডিজিটাল ডিভাইস। অভিভাবকরা বলছেন, এই ধরনের প্রযুক্তিগুলোতে তারা এতটাই আসক্ত যে তাদের যদি কোনকিছু প্রয়োজন হয়, আর সেটিতে বাধা দিলে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, মানবতার প্রধান বাধা প্রযুক্তির অপব্যবহার। প্রতিকার হিসেবে ইন্টারনেট ও অনন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহারই পারে আমাদের একটি সুন্দর সমাজ উপহার দিতে।

একটি সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ১০০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৬৪ জন প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা কোন না কোন ধরনের প্রযুক্তিগত পর্দার সামনে ব্যয় করেন। পরিসংখ্যান বলছে, প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ মানুষ আত্মহত্যা করে।

এছাড়া সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু-কিশোররা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ধাবিত হয় অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রভাবিত হয়ে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমকে (কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, বিভিন্ন অ্যাপলিকেশন সফটওয়্যার, বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও অ্যাপস, ইত্যাদি) দ্রুত যোগাযোগের অন্যতম বাহন হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশে অব্যাহতভাবে চলছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গ্রাহক বেড়েছে ২০ লাখ। এটিও উদ্বেগের কারণ বলছেন গবেষকরা।

2

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ ভার্চুয়ালের সাথে অত্যাধিক সময় ব্যয় করার ফলে আসক্তির সৃষ্টি হয়। প্রযুক্তিকে যোগাযোগের প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করলে সমস্যা নেই। তবে এটিকেই যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করলে কিংবা সব কিছুতেই প্রযুক্তির আশ্রয় নিলে সরাসরি যোগাযোগ কিংবা সামাজিকীকরণ উপেক্ষিত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তি কেবল সংযোগের একটি মিথ্যা অনুভূতি তৈরি করতে পারে, যেখানে মানুষ বিশ্বাস করে তারা অন্যদের সাথে যোগাযোগ করছে। আসলে বাস্তবে তারা কেবল পর্দার মাধ্যমে যোগাযোগ করছে। তাদের ডিভাইসে আরও বেশি সময় ব্যয় করে, স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক দক্ষতাগুলোকেও অবহেলা করতে পারে। এটি বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে, কারণ মানুষ তখন সমাজ থেকে সরে যায় এবং প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাই সরাসরি যোগাযোগ ও প্রযুক্তি উভয়ের সুবিধা উপভোগ করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরাসরি যোগাযোগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী অনন্য প্রতীক রাউত এবিষয়ে বলেন, সকালের শুরু থেকে রাতের ঘুম পর্যন্ত আমাদের জীবনটা গেঁথে আছে প্রযুক্তিতে। জীবনকে সহজ যেমন করছে প্রযুক্তি, তেমনি মানুষের মাঝে বিভেদ, নিজস্ব স্বকীয়তা হারাতে বাধ্য করে তুলছে। ছোট্ট একটা মোবাইল ফোন এবং এর অপব্যবহারের কথাই ভাবুন। মানুষের জীবনকে তছনছ কিংবা নিঃস্ব করে দিতে পারে শুধুমাত্র একটু অসতর্কতাই। বিশেষত ব্যাংকিং, পেমেন্ট কিংবা মানুষকে সমাজবিরুদ্ধ যে কোনো কাজে যুক্ত করতে এই প্রযুক্তি তথা নেটওয়ার্কের সর্বোচ্চ ব্যবহারটাই করে অপরাধীচক্র। পাশাপাশি ইন্টারনেট বেস্টড বিভিন্ন চক্র মানুষকে প্রতিনিয়ত হয়রানি করে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আজকাল ইন্টারনেট ও এর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা সহজেই জাল বিস্তার করে চলেছে। ফলশ্রুতিতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে মানবসভ্যতা। এমতবস্থায় আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প দেখি না। প্রয়োজনে তথ্য-প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানসন্মত যে কোনপ প্রযুক্তির অপব্যবহার রুখে দিতে তৈরি করা হোক যুগোপযোগী আইন বা আইনে আনা হোক সময়োপযোগী সংশোধনী। পাশাপাশি সৃষ্টি করা হোক এর শতভাগ স্বচ্ছ বাস্তবায়ন।

1

এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইয়াসিন আল রাজী বলেন, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং অপরাধ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা যা তরুণ প্রজন্মের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। সাইবার বুলিং, অনলাইন স্ক্যাম, মাদকপাচার, এমনকি সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে অপরাধীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক তরুণও এতে জড়িয়ে পড়ছে। যদিও প্রযুক্তির অনেক উপকারিতা রয়েছে, তনুও কিছু ক্ষেত্রে এর অপব্যবহার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়াকে সহজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধ বেনামে এবং দূর থেকে করা যায়। এটি ভুক্তভোগীদের জন্য অপরাধীদের সনাক্ত করা এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করাকে কঠিন করে তোলে। আবার প্রযুক্তির সাহায্যে অনলাইন স্ক্যাম এবং মাদক পাচারের মতো অপরাধকেও ব্যাপকতা প্রদান করা যায়, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা কঠিন করে তোলে। তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য অপরাধের তদন্ত কাজকে সহজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, অপরাধীদের সনাক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য অনলাইন তথ্য ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়াও উন্নত প্রযুক্তি যেমন- ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার এবং সিসিটিভি ফুটেজের ব্যবহারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ইয়াসিন আল রাজী আরও বলেন, আশার কথা হলো- প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং অপরাধ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশে শক্তিশালী আইন আছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও সরকার সাইবার ক্রাইম মোকাবেলায় বেশ কিছু সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে- যেমন বাংলাদেশ কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম এবং বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং এর মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন বাংলাদেশে একটি গুরুতর সমস্যা দাঁড়িয়েছে। সমস্যাটি আরও প্রকট হয়ে উঠছে যখন তরুণ প্রজন্ম এতে জড়িয়ে পড়ছে। যদিও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠীতে পরিণত করতে পারে। এটির অপব্যবহার জাতির জন্য অশান্তির কারণ হয়েও দাঁড়ায়। সুতরাং সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের আরও সচেতনতা ও শিক্ষার প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে আমরা প্রযুক্তিকে পরিহার করে চলতে পারব না, বরঞ্চ প্রযুক্তির দক্ষ এবং সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে বিশ্বে সম্মানের আসনে আসীন হতে পারবো।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রযুক্তি যখন কোনো একটি সমাজে প্রবেশ করে তখন দ্রুত মানুষ সেটাকে গ্রহণ করে। কিন্তু এই প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটা মানিয়ে নিতে সময় লাগে। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি যে জিনিসগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে- সেটি মূলত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার একটি অংশ। মুনাফার জন্য এই নতুন সংস্কৃতিগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তির এই নতুন সংস্কৃতিগুলো যে কতটা বিপদজনক তা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা এটাকে বিনোদনের অংশ হিসেবে নিচ্ছি।

জিয়া রহমান আরও বলেন, মানুষের যখন সামাজিক বাঁধন নষ্ট হয়ে যায়, তখন সে বিচ্যুতিমূলক আচরণ করে। তরুণ প্রজন্মকে ভালো কাজের মধ্যে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। সামাজিক কার্যকলাপ বাড়াতে হবে। পলিসির মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে হবে। এছাড়া আমাদের যে কিশোর অপরাধ সংশোধনীগার কেন্দ্র আছে, সেখানে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যেমন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, ভালো মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম ও সাইকোলজিকাল প্রোগ্রাম- এগুলো জোরদার করা। সমাজের ভেতর থেকে পরিবর্তন করা দরকার এবং রাষ্ট্রকেও নতুন পলিসি প্রদান করতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d